লু এক কথায় তার প্রস্তাবটি নাকচ করে দেয়, নিরাপত্তার খাতিরে সে কাউকে সিসিয়ানের বাইরে যেতে দেবে না। পল বেশি অবাক হল না,লু তাকে যেতে দেবে, সে নিজেও তা বিশ্বাস করে নি।
সিসিয়ানে আরো ঘন্টা দুয়েক সময় কেটে গেল, কোনো কিছুই ঠিক করে জানা নেই, সবার ভিতরে একটা অনিশ্চয়তা, একটা অস্থিরতা। সবার নিরাপত্তার ব্যবস্থা ঠিক রেখে কী ভাবে গ্রহটা নিয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া যায়, লু বা অন্য কেউ ভেবে পাচ্ছিল না।
পল আরো কয়েকবার লুয়ের কাছে স্কাউটশিপে যাবার অনুমতি চাইল, কিন্তু কোনো লাভ হল না। পলের যুক্তি কিন্তু খুব সহজ, সিসিয়ানে থেকে তারা সন্দেহাতীতভাবে ট্রাইটনে কোনো উন্নত প্রাণীর চিহ্ন পায় নি। একটি মাত্র প্রমাণ থাকতে পারে স্কাউটশিপে, যদি সেটি সত্যি দেখা যায় তা হলে বুঝতে হবে এখানে সত্যি অসাধারণ বুদ্ধিমান প্রাণী আছে, তা হলে সবাই ফিরে যেতে পারে। আবার যদি দেখা যায় জিনিসটি একটা যান্ত্রিক গোলযোগ, তাহলেও তারা ফিরে যেতে পারে, কারণ গ্রহটিতে বুদ্ধিমান বা বোকা কোনো প্রাণই নেই। জিনিসটি সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হবার একটিমাত্র উপায়, সিসিয়ান থেকে কোনাস নামে একটি জটিল যন্ত্র নিয়ে স্কাউটশিপে যাওয়া। স্কাউটশিপে কোনাস দেয়া হয় নি, কারণ এটার প্রয়োজন হতে পারে, কারো জানা ছিল না।
লু রাজি না হলে স্কাউটশিপে যাওয়া সম্ভব না, তবু পল কুম সিডিসিকে এরকম। একটা যাত্রায় বিপদের ঝুঁকির একটা পরিমাপ করতে আদেশ দিল। সিডিসির হিসেব দেখে লু শেষ পর্যন্ত একটু নরম হয়, কারণ সিডিসির মতে স্কাউটশিপের ভিতর আর সিসিয়ানের ভিতরে বিপদের ঝুঁকি প্রায় এক সমান। স্কাউটশিপে যাওয়া ব্যাপারটিতে খানিকটা অনিশ্চয়তা আছে, কিন্তু তার পরিমাণ এখানে এক দিন বেশি থাকার অনিশ্চয়তা থেকে কম। কাজেই পল কুম স্কাউটশিপে গিয়ে যদি সবাইকে নিয়ে এক দিন আগে ফিরে যেতে পারে, সেটা সবার জন্যে ভালো। তবে সিডিসি জানিয়ে দিল, পল যে পোশাক পরে যাবে সেটা সে সিসিয়ানে ফিরিয়ে আনতে পারবে না। সেটি এমন কিছু জটিল ব্যাপার নয়, রুটিনমতো অনেকবার করা হয়েছে।
লু শেষ পর্যন্ত রাজি হল, কিন্তু পলকে সে একা যেতে অনুমতি দিল না, রু-টেককে সাথে নিয়ে যেতে হবে। কাজটি একজনের কাজ, কিন্তু রু-টেক থাকবে নিরাপত্তার জন্যে। রু-টেক রবোট বলে তার কর্মক্ষমতা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মানুষ থেকে অনেক গুণ বেশি।
পল কুম বিশেষ পোশাক পরে সাথে সাথে প্রস্তুত হয়ে নেয়, রু-টেকের বিশেষ পোশাকের প্রয়োজন নেই, কয়েকটা সুইচ টিপে সে নিজেকে প্রস্তুত করে নেয়। পল কুমের পিঠে ক্রুকোলাস নামের সেই বিশেষ যন্ত্রটি, রু-টেকের পিঠে একটা অ্যাটমিক ব্লাস্টার; প্রয়োজনে সেটা দিয়ে একটা ছোটখাটো উপগ্রহ উড়িয়ে দেয়া যায়। দু’জন হাতে দুটি ছোট জেট নিয়ে বিশেষ ডকে এসে হাজির হয়। উপর থেকে ঢাকা দিয়ে ঢেকে তাদের আলাদা করে ফেলার আগে কিম জিবান পল কম আর রু-টেকের হাত ধরে একবার ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, সাবধানে থেকো।
পল কুম হেসে বলল, সেটা নিয়ে কোনো সন্দেহ করো না।
কয়েক মিনিটের ভিতরে ডকের সব বাতাস সরিয়ে নিয়ে তাদেরকে একটা গোল গর্ত দিয়ে সিসিয়ানের বাইরে বের করে দেয়া হয়। দু জন তাদের জেটগুলি চালু করে দিতেই মাথায় লাল আলো জ্বলতে এবং নিভতে শুরু করে। সিসিয়ানের সবাই নিঃশ্বাস বন্ধ করে দেখে পল কুম আর রু-টেক দ্রুত তাদের থেকে সরে যাচ্ছে।
তখনো কেউ জানত না তাদের পরবর্তী দুঃস্বপ্নের সেটা ছিল শুরু।
০৩. দুঃস্বপ্নের শুরু
রু,
কি?
ভয় লাগছে তোমার?
লাগছিল, তাই ভয়ের সুইচটা একটু আগে বন্ধ করে দিয়েছি।
পল কুম জেটটা দিয়ে সাবধানে ডানদিকে ঘুরিয়ে বলল, কী মজা তোমাদের, যখন খুশি যেটা ইচ্ছা বন্ধ করে দিতে পার।
তোমার ভাই ধারণা? চাও আমার মতো হতে?
অন্য কোনো সময় চাই নি, কিন্তু এখন মনে হচ্ছে ব্যাপারটা খারাপ না।
কেন জানি রু-টেকের একটু মন-খারাপ হয়ে গেল, সাবধানে একটা দীর্ঘশ্বাস গোপন করে সে। মানুষের এত কাছাকাছি হয়েও সে কখনো মানুষ হতে পারবে না।
ঘুটঘুটে অন্ধকার চারদিকে, ওদের মাথার উপর থেকে যে-আলো বের হচ্ছে, সেটা অন্ধকারকে দূর করতে পারে না, অন্ধকার দূর করতে হলে আলোকে ছড়িয়ে পড়তে হয়, এখানে বায়ুমণ্ডল নেই বলে আলো ছড়ানোর কোনো উপায় নেই। ওদের পিঠে জেট গুলি লাগানো, হাতে কন্ট্রোল, গতিবেগ বাড়িয়ে শ’খানেক কিলোমিটার করে নিয়েছে, স্কাউটশিপের কাছে গিয়ে কমিয়ে নেবে। রু-টেক এসব কাজ খুব ভালো পারে, লু তাই ওকে পলের সাথে পাঠিয়েছে। নিচে গ্রহটিকে দেখা যাচ্ছে, ঈষৎ লালাভ একটা গ্রহ, গোল গোল গর্তের মতো জিনিসগুলি নাকি আস্তে আস্তে নড়ছে, খালিচোখে ধরা পড়ে না, কিন্তু ব্যাপারটি চিন্তা করেই কেমন একটা অস্বস্তি হয়। পল কুমের মনে হল, কিম জিবান ঠিকই বলেছিল যে ওগুলি চোখ, ঐ চোখ দিয়ে কেউ ওদের দেখছে।
কিছুক্ষণের মাঝেই ওরা স্কাউটশিপের কাছে পৌঁছে গেল, সিসিয়ানের সবাই ওদের সাথে যোগাযোগ রাখছে। ব্লু-টেকের ঘাড়ের উপর যে-ক্যামেরাটি আছে, সেটা দিয়ে সবাই সবকিছু দেখতে পাচ্ছে। পল কুম আর রু–টেক মাঝে মাঝে একটি দুটি কথা বলে আশ্বস্ত রাখছে সবাইকে।
স্কাউটশিপের দরজা খুলে প্রথমে ভিতরে ঢেকে রু-টেক, পিছু পিছু পল কুম। ভরশূন্য পরিবেশে দু’জনে একটা পাক খেয়ে নেয়, তারপর ঘুরেফিরে একপলক দেখে নেয় চারদিক, রু-টেক সাবধানে ডান হাতে অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা ধরে রাখে, কে জানে, কোনো কোনায় যদি ঘাপটি মেরে বসে থাকে কোনো-এক বীভৎস প্রাণী। কোথাও কিছু নেই, ঠিক যেভাবে ওরা স্কাউটশিপটিকে পাঠিয়েছিল, সেভাবেই এটা ফিরে এসেছে। পল কুম তার ঘাড় থেকে কোনাসটা নামিয়ে বসাতে শুরু করে, ছোট একটা পরীক্ষা করতে হবে, দশ মিনিটের বেশি লাগার কথা নয়। ব্লু-টেকের কিছু করার নেই, সে পলকে নিরিবিলি কাজ করতে দিয়ে অ্যাটমিক ব্লাস্টারটা হাতে নিয়ে ভেসে বেড়াতে থাকে। মিনিট দুয়েক সে স্কাউটশিপকে লক্ষ করে প্রথমে সাধারণ আলোতে, তারপর আলট্রাভায়েলেটে, তারপর কী মনে করে এক্স-রে দিয়ে। কিছু-একটা অস্বাভাবিক জিনিস আছে এখানে, রু-টেক ঠিক বুঝতে পারে না সেটা কি। দেয়ালের কাছে এগিয়ে যায় সে, খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে থাকে দেয়ালটিকে, এলুমিনিয়াম, ক্যাডমিয়াম আর সিলঝিনিয়ামের সঙ্কর ধাতুর তৈরি, চকচকে মসৃণ দেয়াল। আরো মিনিট খানেক লাগে ওর বুঝতে, ঠিক কী জিনিসটি অস্বাভাবিক, এই স্কাউটশিপের দেয়ালে কোনো ত্রুটি নেই। মহাকাশ গবেষণাগারে তৈরি হয় এগুলি, তৈরি করার পর গামা-রে দিয়ে দেয়ালের ত্রুটি পরীক্ষা করা হয়, শতকরা তিন ভাগ পর্যন্ত ত্রুটি সহ্য করা হয়, এর বেশি হলে পুরোটা আবার নূতন করে তৈরি করতে হয়। সাধারণ মানুষের চোখে এসব কখনো ধরা পড়ে না, কিন্তু রু-টেক তার এক্স-রে সংবেদনশীল চোখ ব্যবহার করে ইচ্ছা করলে ধরতে পারে। র-টেকের কাছে খুব অস্বাভাবিক লাগে যে এটার দেয়ালে কোনো ত্রুটি নেই। সিসিয়ানের দেয়ালে পর্যন্ত নানারকম ত্রুটি আছে, আর এটি তো সাধারণ একটা স্কাউটশিপ। কোথায় তৈরি হয়েছে এই স্কাউটশিপ?