- বইয়ের নামঃ টাইট্রন একটি গ্রহের নাম
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ শিখা প্রকাশনী
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
» ০১. অশুভ গ্রহ
সবাই গোল হয়ে ঘিরে আছে বড় মনিটরটি, একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে গ্রহটির দিকে। অত্যন্ত নিখুঁত বিশ্লেষণ করার উপযোগী মনিটর, নব্বই হাজার কিলোমিটার দূরের আশ্চর্য গ্রহটিকে স্পষ্ট ফুটিয়ে তুলেছে। কিম জিবান, দলের ইঞ্জিনিয়ার, মনিটরের বিভিন্ন নবগুলি টিপে টিপে গ্রহটির ছবিটিকে আরো স্পষ্ট করার চেষ্টা করছিল। মনিটরে গ্রহটির আশ্চর্য রংগুলির বেশির ভাগই কৃত্রিম, কিম জিবানের দেয়া, খানিকটা দেখতে সুবিধা হওয়ার জন্যে, এবং খানিকটা ভালো দেখানোর জন্যে সে ব্যক্তিগত জীবনে শিল্পী, অন্তত নিজে তাই বিশ্বাস করে, তাই কোনো কাজ না থাকলে মনিটরের একঘেয়ে ছবিগুলিতে রং দিয়ে একটু বৈচিত্র্য আনার চেষ্টা করে। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের ফাইল খুঁজে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, কাজটা বা মাত্রার বেআইনি কাজ, কিন্তু সেটা নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না, সবাই একসাথে থাকলে শব্দ করে হাঁচি দেয়াও নাকি যষ্ঠ মাত্রার বেআইনি কাজ। কি জিবান আজ খুব সুবিধে করতে পারছে না, গ্রহটিতে এমন একটা কিছু আছে, যে, যতই রং দেয়ার চেষ্টা করুক, কিছুতেই সেটাকে দেখতে ভালো লাগানো যাচ্ছে না। খোঁচা খোঁচা দাড়ি ঘষতে ঘষতে কিম জিবান পুরো গ্রহটিতে এক পোঁচ নীল রং নিয়ে দেয়, নীল রংয়ে যে-কোনো গ্রহকে ভালো দেখায়, কিন্তু এবারে সেটা নিয়েও কোনো লাভ হল না। বড় বড় গোলাকার গর্ত, যেগুলি নাকি খুব ধীরে ধীরে আকার পরিবর্তন করছে, গ্রহটিকে একটি কুৎসিত সরীসৃপের রূপ দিয়েছে, নীল রংয়ের সরীসৃপ এমন কিছু সুদর্শন বস্তু নয়।
লু মহাকাশযান সিসিয়ানের দলপতি। দলপতির দায়িত্ব অন্যদের থেকে বেশি, কথাটা পুরোপুরি সত্যি নয়। যখনি কোনো সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সিসিয়ানের মূল কম্পিউটার সিডিসি তাকে সাহায্য করে। সিডিসি চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটার, পৃথিবীতে চতুর্থ মাত্রার কম্পিউটারের সংখ্যা হাতে গোনা যায়। তার স্মৃতিভাণ্ডারে শুধু যে অপরিমেয় তথ্য রয়েছে তাই নয়, প্রয়োজনে যে-কোনো মেমোরি ব্যাংকে যোগাযোগ করে প্রয়োজনীয় জিনিস জানার অধিকার এবং ক্ষমতা দুইই তার আছে। সিডিসি ছাড়াও মহাকাশযানে অন্যান্য বিজ্ঞানীরা রয়েছে, এটি একটি অনুসন্ধানী মহাকাশযান, এখানে সবাই কোনো-না-কোনো ধরনের বিজ্ঞানী। লুকে যখন সিদ্ধান্ত নিতে হয়, সে অন্য বিজ্ঞানীদের সাথে আলোচনা করে, যেটা সবাই ভালো মনে করে, সেই সিদ্ধান্তই নেয়া হয়। তবে তিন মাত্রা বা তার থেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে হলে লুকে আনুষ্ঠানিকভাবে সেটি উচ্চারণ করতে হয়, শুধুমাত্র তার গলার স্বরই সিসিয়ানের চার হাজার ভিন্ন ভিন্ন কম্পিউটারে প্রোগ্রাম করা আছে, এবং শুধুমাত্র সেই তার গলার স্বর দিয়ে সিদ্ধান্তগুলি কার্যকর করতে পারে। এখন যদি গ্রহটিতে না গিয়ে ফিরে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, সেটা হবে তিন মাত্রার সিদ্ধান্ত। মহাকাশযান সিসিয়ান ধ্বংস করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হচ্ছে প্রথম মাত্রার সিদ্ধান্ত, সেটি আবার সে একা নিতে পারে না, আরো দু’জন বিজ্ঞানীকে একইসাথে নিতে হয়। মহাকাশযানের নিয়মকানুনের কোনো শেষ নেই, দৈনন্দিন জীবনে কখনো তার প্রয়োজন হয় না, তাই সেগুলি নিয়ে কারো মাথাব্যথা নেই।
লু নিজের ঠোঁট কামড়াতে কামড়াতে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে ছিল, যখনই সে কোনো সমস্যায় পড়ে, সে নিজের অজান্তে নিচের ঠোঁট কামড়াতে থাকে। এই মুহূর্তে তাকে কী সমস্যায় ফেলেছে বলা মুশকিল। মাসখানেক আগে একটা মনুষ্যবিহীন মহাকাশযান প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় এই গ্রহটির ছবি তুলেছিল। এই বিশাল বিশ্বব্রহ্মাণ্ডে গ্রহ-উপগ্রহের কোনো সীমা নেই, কিন্তু মানুষের সংখ্যা সীমিত, কাজেই বিজ্ঞানীরা নিজের চোখে সব গ্রহ-উপগ্রহ দেখে আসতে পারে না। গুরুত্বপূর্ণ হলে বড়জোর একটা স্কাউটশিপ পাঠানো হয়। এই মহাকাশযানটির কথা ভিন্ন, কারণ প্রটোনিয়াম আকরিক নিয়ে যে-মহাকাশযানটি যাচ্ছিল, সেটি যেছবি তুলে এনেছে, সেটি দেখলে মনে হয় গ্রহটির আকার খুব আশ্চর্যভাবে পাল্টে যায়। এ-ধরনের গ্রহ খুব কম, কেন্দ্রীয় বিজ্ঞান আকাদেমির এজন্যে এটার উপর খুব কৌতুহল। লু মহাকাশযান সিসিয়ান নিয়ে একটি অভিযান শেষ করে ফিরে আসছিল, বিজ্ঞান আকাদেমি তাকে একটু ঘুরে এই গ্রহটা পর্যবেক্ষণ করে ফিরে আসতে বলেছে। লু নিজের ঠোঁট কামড়ে বিজ্ঞান আকাদেমির মুণ্ডপাত করে, কোনো যুক্তি নেই, কিন্তু ওর ভিতরে একটা অশুভ অনুভূতি হচ্ছে, কেন জানি মনে হচ্ছে এই গ্রহটার কাছে যাওয়া একটা দুর্ভাগ্যের লক্ষণ।
লু একটু ঝুঁকে পড়ে কিম জিবানকে বলল, কিম, তোমার দেয়া রংগুলি সরাও তো একট, দেখি জিনিসটা আসলে দেখতে কেমন।
কিম জিবান হাত নেড়ে লুয়ের কথা উড়িয়ে দিয়ে বলল, আসল জিনিস দেখে কী করবে? এটা দেখ, বেশ দেখাচ্ছে এখন।
বেশ দেখাচ্ছে? সুশান চোখ কপালে তুলে বলল, এটা তোমার কাছে দেখতে বেশ লাগছে? তোমার মাথা পরীক্ষা করানো উচিত, এত কুৎসিত জিনিস আমি আমার জনে দেখি নি।
সুশান মহাকাশযানের দু’জন জীববিজ্ঞানীর একজন। তাকে তার জীবনে অসংখ্য কুৎসিত জীবজন্তু এবং কীটপতঙ্গ দেখতে হয়েছে, সে যদি কোনো কিছুকে কুৎসিত দাবি করে, জিনিসটি কুৎসিত তাতে সন্দেহ নেই। সুশানের বয়স বেশি নয়, এই বয়সে সব মেয়ের চেহারাতেই একটা মাধুর্য এসে যায়, সুশানেরও এসেছে। কে জানে সে যদি পৃথিবীতে থাকা আর দশটি মেয়ের মতো চুল লম্বা করে চোখে রং দেয়া শুরু করত, তাকে হয়তো সুন্দরীই বলা হত। মহাকাশযানে চুল লম্বা করা চতুর্থ এবং চোখে রং দেয়া নাকি পঞ্চম মাত্রার অপরাধ।