হ্যাঁ, কাজ।
কী কাজ?
গভীর সমুদ্রে যারা গেছে তাদের খবর দিতে হবে।
খবর?
হ্যাঁ।
কী খবর?
টাইফুনের খবর। তাদের চলে আসতে বলব।
শুশুকে আবার উদ্বিগ্ন দেখায়। সে তার নিজের ভাষায় বলে, টাইফুন খারাপ। বেশি খারাপ।
হ্যাঁ। টাইফুন খারাপ, বেশি খারাপ। এখন চল যাই।
শুশু আনন্দে আবার পানি থেকে বের হয়ে এসে একটা পানির ঝাপটায় নিহনকে ভিজিয়ে দিল। বলল, চল, বন্ধু চল।
নিহন আলগোছে শুশুকে জড়িয়ে ধরে, শুও সঙ্গে সঙ্গে তার শক্তিশালী শরীরটা একটা ঝাঁকুনি দিয়ে সমুদ্রের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। পানি কেটে শুশু সোজা সামনের দিকে ছুটে যেতে থাকে। পানির ঝাপটায় নিহন কিছু দেখতে পায় না। নিহন কপাল থেকে টেনে গগলসটা চোখের ওপর নিয়ে আসে। শুশু নিহনকে নিয়ে হঠাৎ পানির নিচে ঢুকে যেতে থাকে, এটা। এক ধরনের দুষ্টুমি। পানির নিচে খানিকটা ঢুকে হঠাৎ করে শুশু সোজা ওপরের দিকে ছুটে আসে, নিহন শুশুকে ধরে রাখতে পারে না-ছিটকে পানিতে গিয়ে পড়ে। পুরো ব্যাপারটায় শুশু খুব আনন্দ পায়, ডলফিনের যে কৌতুক বোধ আছে সেটা নিহন কখনো জানত না। শুশুকে দেখে সে সেটা জেনেছে।
নিহন পানিতে গা ভাসিয়ে শুয়ে থাকে, নিচে থেকে শুও এসে তাকে নিজের ওপর তুলে নিয়ে আবার ছুটে যেতে থাকে। নিহন শুর শরীরে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলে, গুণ্ড। দুই মেয়ে।
উত্তরে শুশু কিছু একটা বলে, পানির ঝাপটার জন্য নিহন কথাটি শুনতে পায় না। নিহন শুশুর পিঠে চেপে বসে দুটি পা দুদিকে দিয়ে শক্ত করে চেপে ধরেছে। শুশুর শরীরের সঙ্গে নিহন তার দেহটা শক্ত করে চেপে রাখে। শুশু পানি কেটে ছুটে যাচ্ছে-কোথায় যেতে হবে সে জানে, পানির মধ্যে ইঞ্জিনের পোড়া তেলের গন্ধটুকু সে বহু দূর থেকে ধরতে পারে।
প্রায় ঘণ্টা দুয়েক পর নিহন বহু দূরে মাহার নৌকাটা দেখতে পেল। ইঞ্জিনটা বন্ধ করে মাহা বিশাল একটা জাল টেনে তুলছে। জালের মধ্যে সামুদ্রিক মাছ আটকে আছে, সেগুলো ছটফট করে ছুটে পালানোর চেষ্টা করছে। নিহনকে দেখতে পেয়ে মাহা তার জাল টেনে তোলানো থামিয়ে একটু অবাক হয়ে গলা উঁচিয়ে চিৎকার করে বলল, কী ব্যাপার, নিহন? তুমি এখানে?
বলছি দাঁড়াও। নিহন শুশুকে নিয়ে মাহার নৌকার কাছে গিয়ে থামল। মাহা আর তার স্ত্রী নীহা নিহনকে নৌকায় উঠতে সাহায্য করে। নিহন নৌকায় বসে গগলসটা চোখ থেকে খুলে কপালে লাগিয়ে বলল, তোমাদের জন্য দুটি খবর নিয়ে এসেছি। একটা ভালো, একটা খারাপ। কোনটা আগে শুনতে চাও বল।
মাহার কমবয়সী স্ত্রী নীহা বলল, আমি কোনো খারাপ খবর শুনতে চাই না। শুধু ভালো খবরটা শুনব।
শুধু ভালো খবর শুনলে কেমন করে হবে? খারাপ খবরটাও গুনতে হবে। নিন গম্ভীর মুখে বলল, একটা বাজে ধরনের টাইফুন আসছে। তোমাদের এক্ষুনি ফিরে যেতে হবে।
সত্যি? মাহা আকাশের দিকে তাকিয়ে বলল, ঠিকই বলেছ, দেখেছ আকাশটা কেমন হয়ে যাচ্ছে। মাহার স্ত্রী নীহা বলল, খারাপটা তো শুনলাম। এখন ভালো খবরটা বল শুনি।
আমাদের নূতন দলপতি হচ্ছে, কায়ীরা।
মাহা এবং নীহার চোখ একসঙ্গে উজ্জ্বল হয়ে উঠল। সত্যি?
হ্যাঁ। রিসি বুড়ো একটু আগে কায়ীরাকে দায়িত্ব দিয়েছে।
সত্যি? কায়ীরা আমাদের নূতন দলপতি? নীহা ছেলেমানুষের মতো খুশি হয়ে ওঠে।
হ্যাঁ সত্যি।
কী মজা তাই না?
হ্যাঁ। খুব মজা। কায়ীরা আমাকে পাঠিয়েছে তোমাদের সবাইকে ফিরিয়ে নিতে।
চল ফিরে যাই মাহা উঠে দাঁড়িয়ে তার জাল গুটিয়ে নিতে শুরু করে। নীহা জাল থেকে মাছগুলো খুলে নৌকার মাঝখানে রাখতে শুরু করে। নিহন দুজনের সঙ্গে হাত। লাগায়। শুৎ নৌকাটা ঘিরে ঘুরছিল, এবার পানি থেকে লাফিয়ে বের হয়ে নিহনের দৃষ্টি আকর্ষণ করার চেষ্টা করল। নিহন গলা উঁচিয়ে বলল, আসছি, শুও। আসছি। মাহা আর নীহা তাদের কাজ গুছিয়ে নেবার পর নিহন আবার শুশুর পিঠে চেপে বসল। তার শরীরে হাত বুলিয়ে নরম গলায় বলল, তোমার খুব পরিশ্রম হচ্ছে, তাই না শুশু?
শুশু মাথা নাড়ে, বলে, না, পরিশ্রম না।
তা হলে?
শুশু আনন্দের ভঙ্গি করে বলল, আনন্দ।
নিহন শুশুর মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তুমি খুব লক্ষ্মীমেয়ে। তোমাকে আমি খুব ভালবাসি।
শুশু মাথা নাড়ল, বলল, ভালবাসি। আমি ভালবাসি।
চল এখন। আর কেউ বাকি কি না খুঁজে দেখি।
চল চল। নিহনকে পিঠে নিয়ে শুশু প্রথমে শূন্যে ঝাঁপিয়ে ওঠে, তারপর সমুদ্রের গভীরে ডুবে যায়। নিহন নিঃশ্বাস আটকে রাখে, সে জানে এগুলো হচ্ছে শু দুষ্টুমি। কয়েক মুহূর্ত পর শুশু নিহনকে নিয়ে আবার ওপরে ভেসে ওঠে। তারপর পানি কেটে ছুটে যেতে শুরু করে। এই দুষ্ট ডলফিনটা না থাকলে নিহন কেমন করে তার কাজ করত?
.
বিকেলবেলা যখন নিহন ফিরে এসেছে, তখন সে তাদের ভাসমান দ্বীপটাকে চিনতে পারে না। মাঝামাঝি অংশটা এর মাঝেই ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্য অংশগুলো আলাদা করে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। সেগুলোও ডুবিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুতি নেওয়া হচ্ছে। বড় বড় পাম্পগুলো গর্জন করে কাজ করছে। মোটা শেকল দিয়ে ভাসমান দ্বীপগুলোকে নোঙর করে রাখার ব্যবস্থা করা হয়েছে। দ্বীপের দুই হাজার মানুষের সবাই কোনো না কোনো কাজ করছে। ছোট ছোট বাচ্চাদেরও কাজে লাগিয়ে দেওয়া হয়েছে, তারা বড় বড় বাক্সে জিনিসপত্র গুছিয়ে রাখছে। একেবারে যারা শিশু শুধু তাদের আলাদা করে রাখা হয়েছে। কয়েকজন মা তাদের নিয়ে ব্যস্ত রয়েছে। ক্রিটিনা ছোট অক্সিজেন মাস্ক তাদের মুখে পরানোর চেষ্টা করছে এবং বাচ্চাগুলো সেটা নিয়ে প্রবল আপত্তি করে হাত-পা ছুঁড়ে গলা ফাটিয়ে চিৎকার করছে।