ছেলেমেয়েগুলো মাথা নাড়ল। বলল, ঠিক আছে, চল তা হলে রওনা দিয়ে দিই।
নিহন বলল, তোমরা তো নিয়ম জান। দুজন করে একটা দল। নিজেরা দল ভাগ করে রওনা হয়ে যাও। চারদিকে চারটি দল যাও। কে কোথায় গেছে তালিকাটা নিয়ে এসেছি, যাওয়ার আগে তোমরা দেখে নাও।
ছেলেমেয়েগুলো তালিকাটা দেখে কোন দলের কতগুলো নৌকাকে খবর পৌঁছাতে হবে মনে মনে ঠিক করে নেয়। লাল চুলের একটা মেয়ে জিজ্ঞেস করল, আর তুমি, নিহন তুমি কোন দিকে যাবে?
মাহার পরিবার পাওয়ার বোট নিয়ে বের হয়েছে। অনেক দূর চলে গেছে নিশ্চয়ই। আমি তার কাছে যাই।
ঠিক আছে।
ক্রিহা আসছে না, সেটাই হচ্ছে সমস্যা। দেরি করলে বিপদ হয়ে যাবে।
দেরি করবে না। ক্ৰিহা খুব দায়িত্ববান ছেলে। নিহন বলল, তোমরা আমার জন্য অপেক্ষা কোরো না। রওনা হয়ে যাও।
ছেলেমেয়েগুলো বলল, হ্যাঁ যাচ্ছি।
তারা কোমরে ঝোলানো ছোট ব্যাগ থেকে সামুদ্রিক মাছ থেকে তৈরি করা এক ধরনের ক্রিম শরীরে মাখতে থাকে। সমুদ্রের লোনা পানিতে দীর্ঘ সময় থাকতে হলে তারা এই ক্রিমটা শরীরে মেখে নেয়, শরীরের চামড়া তা হলে শুষ্ক বিবর্ণ হয়ে ওঠে না। ক্রিম মাখা শেষ করে তারা তাদের গলায় ঝোলানো আলট্রাসাউন্ড হুইসেলগুলো নিয়ে সমুদ্রের পানিতে মুখ ডুবিয়ে বাজাতে শুরু করে। পোষা ডলফিনগুলো মরণত খুব দূরে যায় না, হুইসেলের শব্দ শুনে তারা ছুটে আসতে শুরু করে। কিছুক্ষপের অধ্যেই সেগুলো ভূশ করে পানি থেকে বের হয়ে আসে। ছেলেমেয়েগুলো ডলফিনগুলোর শরীরে হাত বুলিয়ে আদর করে, তাদের সঙ্গে ফিসফিস করে কথা বলে। তারপর তাদের পিঠে উঠে দেখতে দেখতে সমুদ্রের পানি কেটে দূরে অদৃশ্য হয়ে যায়। সে
নিহন একা দাঁড়িয়ে থাকে। ক্রিহা এখনো আসে নি। দায়িত্ববান ছেলে, তার না আসার কথা নয়। সম্ভবত কোনো ঝামেলায় পড়েছে। টাইফুনের আগে দ্বীপটাকে রক্ষা করার জন্য এক শ ধরনের কাজ করতে হয়। জিহাকে হয়তো হঠাৎ করে সেরকম কোনো দায়িত্ব দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রিহার বদলে আর কাউকে নিতে হবে। এখন সে কাকে খুঁজে পাবে? সবাই নিশ্চয়ই কোনো না কোনো কাজে ব্যস্ত। এক হয় একা চলে যাওয়া, কিন্তু সমুদ্রে একা যাওয়া নিষিদ্ধ-সব সময় সঙ্গে অন্য কাউকে থাকতে হয়। কত রকম বিপদ হতে পারে, সঙ্গে অন্য একজন থাকলে বিপদের ঝুঁকি অনেক কমে যায়। বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটলে এসে খবর দেওয়া যায়।
নিহন আকাশের দিকে তাকাল। ধূসর এক ধরনের মেঘ আকাশে এসে জমতে শুরু করেছে, চারপাশে কেমন থমথমে একটা ভাব চলে এসেছে, তার আর দেরি করা ঠিক হবে না। নিহন ঠিক করল, সে একাই চলে যাবে। সমুদ্রকে তার এতটুকু ভয় করে না। একা একা সে সমুদ্রে বহুবার গেছে, সব নিয়ম যে সব সময় মানা যায় না, সেটা সবাই জানে।
নিহন তার গলায় ঝোলানো হুইসেলটা পানিতে ডুবিয়ে পরপর তিনবার একটা টানা শব্দ। করল। এটা তার পোষা ডলফিনটা, গুণ্ডর সঙ্কেত। সঙ্কেত পেলেই শুও ছুটে আসবে।
নিহন সমুদ্রের পানিতে পা ডুবিয়ে বসে থাকে, বহু দূরে একটা ডলফিনকে পানির ওপর ঝাঁপিয়ে উঠতে দেখে, নিশ্চয়ই শুশু! নিহনকে গুণ্ড অসম্ভব ভালবাসে। নিহন সমুদ্রের পানিতে তাকিয়ে থাকে, দেখতে পায় পানি কেটে শুশু ছুটে আসছে। কাছাকাছি এসে শুশু শূন্যে ঝাঁপিয়ে উঠে তার আনন্দটুকু প্রকাশ করল। তারপর নিহনের কাছে এসে মাথা বের করে দাঁড়াল।
এসেছ শুশু?
শুশুও মাথা নাড়ল। নিহন জিজ্ঞেস করল, সমুদ্রের কী খবর?
শুশু তার গলার ভেতর থেকে এক ধরনের শব্দ করে। শব্দগুলোর অর্থ, ভালো। খুব ভালো।
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, ভালো না। টাইফুন আসছে।
শুশু সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তার ভাষায় জিজ্ঞেস করল, টাইফুন?
হ্যাঁ, টাইফুন। খুব খারাপ একটা টাইফুন আসছে শুশু।
শুশুর মুখে দুশ্চিন্তার একটা ছাপ পড়ে। নিহন এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে ডলফিনটির দিকে তাকিয়ে থাকে। পৃথিবীর মানুষ যখন শুকনো মাটিতে থাকত তখন কখনো কল্পনা করে নি সমুদ্রের এই প্রাণীটি তাদের এতবড় সহায় হয়ে দাঁড়াবে। পৃথিবীর মানুষকে পানিতে ঠেলে দেওয়ার পরও তারা যে নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় নি তার একটা বড় কারণ হচ্ছে এই ডলফিন। বিবর্তনের ধারায় মানুষের পরে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে গেছে ডলফিন। পৃথিবীর মানুষ কখনো কি কল্পনা করেছিল একদিন মানুষ আর ডলফিন পরস্পর কথা বলতে পারবে? অর্থহীন আদেশ-নির্দেশ নয়, কাজ চালানোর মতো কথা। এই দুটি প্রাণী যে এত কাছাকাছি হবে সেটা কি কেউ জানত? কায়ীরা সব সময় বলে যে, জলমানবেরা নাকি জ্ঞান-বিজ্ঞানেও অসাধ্য সাধন করেছে এটাই কি সেই অসাধ্য সাধন?
টাইফুন খারাপ। শুশু বোঝাল এবং দুশ্চিন্তিত ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল, বলল, বেশি খারাপ।
হ্যাঁ। নিহন মাথা নাড়ে। এখন আমাদের গভীর সমুদ্রে যেতে হবে।
শুশু আনন্দে পানি থেকে অনেকটুকু বের হয়ে এসে নিহনের মুখ স্পর্শ করে নিজের ভাষায় অনেক কথা বলে ফেলল, নিহত সব কথা ধরতে পারল না। সমুদ্র আনন্দ খেলা এ রকম বিচ্ছিন্ন কয়েকটা শব্দ শুধু ধরতে পারল। নিহন মাথা নাড়ল, বলল, না, শুশু না। আমি তোমার সঙ্গে খেলা করতে যাচ্ছি না। আনন্দ করতে যাচ্ছি না। কাজ করতে যাচ্ছি। কাজ।
শুশুকে আবার একটু উদ্বিগ্ন দেখায়, কাজ?