প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন মনিটার একটা ত্রিমাত্রিক নকশার দিকে তাকিয়েছিল, তখন খুট করে দরজা খুলে তার একমাত্র মেয়ে কাটুস্কা ঘরের ভেতরে উঁকি দিল। রিওন হাসিমুখে বলল, কী ব্যাপার, কাটুস্কা?
বাবা, তুমি কি খুব ব্যস্ত?
হ্যাঁ মা, আমি খুব ব্যস্ত। কিন্তু আমি যত ব্যস্তই থাকি না কেন তোমার জন্য আমার সময় আছে। এস।
আমি একেবারেই বেশি সময় নেব না।
তুমি যত খুশি সময় নিতে পার। বল, কী ব্যাপার।
কাটুস্কা ইতস্তত করে বলল, আসলে আমি তোমাকে বিরক্ত করতে চাইছিলাম না, কিন্তু কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারছে না। যাকেই জিজ্ঞেস করি সেই প্রশ্নটা এড়িয়ে যায়। প্রশ্নটা জলমানবদের নিয়ে
রিওনের মুখ হঠাৎ একটু গম্ভীর হয়ে যায়। সে চেয়ারটা ঘুরিয়ে সোজাসুজি তার মেয়ের দিকে তাকাল। জিজ্ঞেস করল, কী প্রশ্ন?
জলমানবেরা কি আমাদের মতো মানুষ?
রিওন সরু চোখে তার মেয়ের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আজ থেকে পঁয়ষট্টি মিলিয়ন বছর আগে একটা উল্কাপাতে পৃথিবীর সব ডাইনোসর মরে গিয়েছিল, তুমি জান?
জানি।
ডাইনোসরদের জন্য তোমার কি দুঃখ হয়? তোমার কি মনে হয় পুরো পৃথিবীর তারা সবচেয়ে সফল প্রাণী, অথচ তারা পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, এটা ভুল?
সেটা তো একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল।
দুই শ বছর আগে যখন সারা পৃথিবী পানিতে ডুবে গিয়েছিল, সেটাও একটা প্রাকৃতিক বিপর্যয় ছিল। আমরা অল্প কিছু মানুষ উঁচু জায়গায় থাকি বলে বেঁচে গিয়েছি। যারা নিচু জায়গায় থাকে তারা সব পানিতে ডুবে গিয়েছিল। অল্প কিছু মানুষ নৌকায়, জাহাজে এটা সেটা করে ভেসে ভেসে বেঁচে থাকার চেষ্টা করেছিল। আমরা সবাই জানতাম, কয়েক মাস কিংবা কয়েক বছরে তারা শেষ হয়ে যাবে।
রিওন কথা বন্ধ করে আঙুল দিয়ে টেবিল ঠোকা দিতে দিতে অন্যমনস্ক হয়ে গেল। কাটুস্কা বলল, কিন্তু তারা কয়েক মাস এবং কয়েক বছরে শেষ হয়ে গেল না।
রিওন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, তারা সবাই শেষ হয়ে গেল না। কেউ কেউ দুই শ বছর পরও বেঁচে আছে। তাদের বেঁচে থাকাটা পৃথিবীর জন্য একটা সমস্যা
কাটুস্কা বলল, বাবা, তুমি কিন্তু এখনো আমার প্রশ্নের উত্তর দাও নি। জলমানবেরা কি মানুষ?
রিওন একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, পৃথিবীটা পানিতে ডুবে যাওয়ার পর পৃথিবীর সম্পদ বলতে গেলে কিছু নেই। যেটুকু আছে সেটার ওপর আমরা নির্ভর করে আছি। জলমানবদের সঙ্গে সেটা ভাগাভাগি করলে কারো কিছু থাকবে না। তাই
তাই কী বাবা?
তাই আমরা একদিন ঘোষণা দিলাম জলমানবেরা মানুষ নয়। কারণ হিসেবে ক্রোমোজমের কিছু জিনের উনিশ-বিশ দেখানো হল-।
কাটুস্কা বুক থেকে একটা নিঃশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, তার মানে আসলে জলমানবেরাও মানুষ। আমরা ইচ্ছে করে তাদের মানুষ বলি না।
তুমি ইচ্ছে করলে সেভাবে বলতে পার, কিন্তু তোমার যেন সেটা নিয়ে কোনো অপরাধবোধ না থাকে। পৃথিবীর প্রাণী টিকে আছে বিবর্তন দিয়ে। যারা শক্তিশালী, যারা বুদ্ধিমান, যারা দক্ষ তারাই টিকে থাকবে। সেটাই নিয়ম। আমরা শক্তিশালী, আমরা বুদ্ধিমান, আমরা দক্ষ তাই আমরা টিকে আছি।
তারাও টিকে আছে।
এই টিকে থাকার কোনো অর্থ নেই, কাটুস্কা। এটা মানুষের সম্মান নিয়ে টিকে থাকা নয়। জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তির কিছু নেই, শুধু পশুদের মতো সহজাত একটা প্রবৃত্তি নিয়ে টিকে থাকা। তার মধ্যে কোনো আনন্দ নেই, কোনো তৃপ্তি নেই, কোনো স্বপ্ন নেই, কোনো ভবিষ্যৎ নেই। জলমানবের এই প্রজন্ম যাচ্ছে বিবর্তনের উল্টো দিকে। সভ্য থেকে অসভ্যের দিকে। এক প্রজন্ম থেকে আরেক প্রজন্ম হচ্ছে আরো হিংস্র, আরো নিষ্ঠুর।
কাটুস্কা কিছু না বলে চুপ করে রইল। রিওন মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলল, তোমাদের এই বয়সটা হচ্ছে আবেগের বয়স। এটা খুবই স্বাভাবিক যে তোমরা এসব নিয়ে ভাববে। কিন্তু সব সময় একটা কথা মনে রেখ_
কী কথা বাবা?
দুঃসময়ে টিকে থাকাটাই বড় কথা। পৃথিবীর এখন খুব দুঃসময়, তাই আমাদের টিকে থাকতে হবে। জলমানব বা অন্যদের কথা ভাবলে আমঝটিকে থাকতে পারব না। বুঝেছ?
বুঝেছি। কাটুস্কা মাথা নাড়ল।
সেজন্য যেন কারো অপরাধবোধের জন্ম না হয়। এটা হচ্ছে প্রকৃতির নিয়ম। যে যোগ্য সে টিকে থাকবে। তাই আমরা যোগ্য হতে চাই। টিকে থাকতে চাই। বুঝেছ?
বুঝেছি, বাবা। কাটুস্কা আবার মাথা নাড়ল। বলল, আমাকে ব্যাপারটা বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ, বাবা।
০৩. নিহন ভাসমান দ্বীপের কিনারায়
নিহন ভাসমান দ্বীপের কিনারায় দাঁড়িয়ে বলল, ক্ৰিহা কোথায়?
একজন বলল, আসছে। আমি খবর দিয়েছি।
তা হলে দেরি করে লাভ নেই। কায়ীরা বলেছে এক্ষুনি যেতে।
আঠার-উনিশ বছরের একটি মেয়ে উজ্জ্বল চোখে বলল, কায়ীরা আমাদের নূতন দলপতি, কী মজা তাই না!
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। দলপতি হওয়ার পর এটা হচ্ছে কায়ীরার প্রথম নির্দেশ। তাই সবাইকে খুব ভালো করে এটা করতে হবে।
ভাসমান দ্বীপের কিনারায় দাঁড়িয়ে থাকা ছেলেমেয়েগুলো বলল, করব। অবশ্যই খুব ভালো করে করব।।
টাইফুন আসছে। কায়ীরা বলছে, আমরা বোঝার আগেই নাকি চলে আসবে। যারা গভীর সমুদ্রে গেছে তাদের কাছে গিয়ে আমাদের খবর দিতে হবে।