দশ হাজার ইউনিট অনেক বেশি। আমার এত ইউনিট নেই। তা ছাড়া-
মাজুর হা হা করে হাসল। বলল, আমাদের প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধানের মেয়ে বলছে তার কাছে দশ হাজার ইউনিট নেই? এটা কি বিশ্বাস করা যায়? তোমার এক পাটি জুতো নিশ্চয়ই দশ হাজার ইউনিট থেকে বেশি হবে!
কাটুস্কা মাথা নেড়ে বলল, প্রশ্নটা আসলে দশ হাজার ইউনিটের না।
তা হলে প্রশ্নটা কিসের?
প্রশ্নটা হচ্ছে আমরা মানুষ হয়ে অন্য মানুষকে শিকার করতে পারি কি না।
মাজুর অবাক হয়ে বলল, পারব না কেন? যুদ্ধে কি এক মানুষ অন্য মানুষকে হত্যা করে না?
এখন কোনো যুদ্ধ হচ্ছে না।
সব সময়েই যুদ্ধ হচ্ছে। একদলকে টিকে থাকার জন্য অন্য দলের সাথে যুদ্ধ করতে হয়।
কিন্তু জলমানবদের সাথে আমাদের যুদ্ধ নেই। তারা এত দূরে সমুদ্রের মাঝে ভেসে। থাকে যে আমাদের সাথে কোনো যোগাযোগই নেই।
মাজুর হা হা করে হেসে বলল, মাঝে মাঝে যোগাযোগ হয়। আমরা যখন তাদের শিকার করতে যাই তখন যোগাযোগ হয়।
কাটুস্কা কোনো কথা না বলে একদৃষ্টে মাজুর দিকে তাকিয়ে রইল।
.
ইনস্টিটিউটের ছোট ক্লাসঘরটিতে বসে কাটুস্কা সোনালি চুলের মধ্যবয়স্কা মহিলাটির কথা মন দিয়ে শোনার চেষ্টা করে। মানবসভ্যতা নিয়ে গুরুগম্ভীর কিছু একটা বলছে, কাটুস্কা মন দিয়ে শুনেও সেটা ভালো করে বুঝতে পারে না।
সভ্যতা একদিনে হয় নি। মহিলাটি প্রায় যান্ত্রিক গলায় বলছে, লক্ষ বছরে এই সভ্যতা গড়ে উঠেছে। এই পৃথিবীতে মানুষ প্রজাতির সবচেয়ে বড় অবদান হচ্ছে তার সভ্যতা। এই সভ্যতাকে ধরে রাখার এবং বিকশিত করে রাখার দায়িত্ব আমাদের_
কাটুস্কা হঠাৎ মহিলার কথার মাঝখানে বাধা দিয়ে বলল, আমাদের বলতে তুমি কাদের বোঝাচ্ছ? আমরা যারা এখানে আছি তারা, নাকি সমগ্র মানবজাতি?
অবশ্যই সমগ্র মানবজাতি।
তার মধ্যে কি জনমানবেরা আছে?
সোনালি চুলের মহিলাটি থতমত খেয়ে বলল, তুমি একটা কৌতূহলোদ্দীপক প্রশ্ন তুলেছ, কাটুস্কা। আমরা নিশ্চয়ই একদিন সেটা নিয়ে আলোচনা করব।
কাটুস্কা একটু অধৈর্য হয়ে বলল, এখন করতে দোষ কী? আমি শুধু জানতে চাইছি জলমানবেরা কি মানবজাতির অংশ?
সোনালি চুলের মহিলাটির মুখ একটু কঠিন হয়ে যায়, বলে, না, তারা মানবজাতির অংশ নয়।
কেন নয়?
মানুষ বলতে কী বোঝায় তার একটি আনুষ্ঠানিক সংজ্ঞা আছে। ক্রোমোজমে জিনসের নির্দিষ্ট কোডিং দিয়ে সেটি করা আছে। সেই সংজ্ঞায় অপমানবেরা মানুষ নয়, তারা মানব সম্প্রদায়ের একটা অপভ্রংশ।
কিন্তু সেটা কি একটা কৃত্রিম বিভাজন নয়?
না, কৃত্রিম বিভাজন নয়। আমরা সভ্যতাকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছি, জলমানবেরা নিচ্ছে।
কাটুস্কা কী বলবে বুঝতে পারল না, ইতস্তত করে বলল, হয়তো তারা সুযোগ পাচ্ছে। সেজন্য পারছে না।
সোনালি চুলের মহিলাটি হেসে বলল, সেটা কি ভালো যুক্তি হল? আমরা তো তা হলে এভাবেও বলতে পারি, চিড়িয়াখানার একটা শিম্পাঞ্জিকে সুযোগ দেওয়া হলে তারাও জ্ঞান বিজ্ঞানের কাজ করত। আমরা যদি তাদের জিনেটিক কোডিংয়ের উন্নতি করার চেষ্টা করতাম
ক্লাসের অনেকে শব্দ করে হেসে উঠল। কাটুস্কা কেন জানি রেগে ওঠে-সে মুখ শক্ত করে বলল, মানুষ আর শিম্পাঞ্জির মধ্যে পার্থক্য আছে।
এক কোনায় বসে থাকা মাজুর গলা উঁচিয়ে বলল, সারা পৃথিবীতে আর কয়টাই বা জলমানব আছে যে তাদের নিয়ে আমাদের চিন্তাভাবনা করতে হবে? একটা করে টাইফুন আসে আর তারা ব্যাক্টেরিয়ার মতো মারা যায়। আমার মনে হয় কয়দিন পরে শিকার করার জন্যও জলমানব থাকবে না!
কথাটা অনেকের কাছে কৌতুকের মতো মনে -তারা সবাই শব্দ করে হেসে উঠল।
কাটুস্কা কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তাকে বাধা দিয়ে সোনালি চুলের মহিলাটি বলল, যে যা-ই বলুক, মানুষ হিসেবে পরিচিত হতে হলে তাকে একটা স্তরে পৌঁছাতে হয়। তাকে জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চা করতে হয়, সভ্যতার বিকাশে অংশ নিতে হয়। যদি সেটা না করে তাদের মানুষ বলা যায় না
কাটুস্কা দুর্বল গলায় বলল, হয়তো তারা করছে। তাদের মতো করে করছে।
মাজুর শব্দ করে হেসে উঠে বলল, কেমন করে করবে? তাদের কি আমাদের মতো একটা কোয়াকম্প আছে? কোয়াকম্প হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার কোয়ান্টাম কম্পিউটার ছাড়া কি এই যুগে বেঁচে থাকা যায়? তারা তথ্য রাখবে কোথায়? বিশ্লেষণ করবে কী দিয়ে? সিমুলেশন করবে কী দিয়ে? সিনথেসাইজ করবে কী দিয়ে?
সোনালি চুলের মহিলা মাথা নেড়ে বলল, মাজুর ঠিকই বলেছে। এক হাজার বছর আগের জ্ঞান সাধনা আর এখনকার জ্ঞান সাধনার মধ্যে অনেক পার্থক্য! তখন সবকিছু করতে হত মস্তিষ্ক দিয়ে। এখন কোয়ান্টাম কম্পিউটার মানুষের মস্তিষ্ক থেকে অনেক শক্তিশালী, এখন আমরা জ্ঞান সাধনা করি এই কোয়ান্টাম কম্পিউটার দিয়ে। সর্বশেষ কোয়ান্টাম কম্পিউটারটা হচ্ছে কোয়াকম্প। আমাদের মস্তিষ্ক শুধু কোয়াকম্প ব্যবহার করতে শেখে। মস্তিকের মূল কাজ এখন উপলোগ। বিনোদন। সভ্যতার একটা বিশেষ পর্যায়ে আমরা পৌঁছেছি। মানুষ কখনো ভাবে নি আমরা এই পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব…
কাটুস্কা আস্তে আস্তে অন্যমনস্ক হয়ে যায়। সোনালি চুলের মহিলাটি কী বলছে সে ভালো করে শুনতেও পায় না। সভ্যতা, জ্ঞান সাধনা, শিল্প-সাহিত্য এই কথাগুলো মাঝে মধ্যে কানে ভেসে আসে কিন্তু সেই কথাগুলোর কোনো অর্থ আছে কি নেই, কাটুস্কা সেটাও যেন বুঝতে পারে না।