সাইকাডোমের মাঝামাঝি একটা বড় স্টেজ, সেখানে কিছু মানুষ তাদের শরীরের সঙ্গে ইলেকট্রনিক সিনথেসাইজার লাগিয়ে উৎকট ভঙ্গিতে নাচানাচি করছে, তাদের অঙ্গভঙ্গির সঙ্গে সঙ্গে উদ্দাম এক ধরনের সঙ্গীতের সৃষ্টি হচ্ছে। কমবয়সী ছেলেমেয়েগুলোর অনেকেই তার সাথে তাল মিলিয়ে নাচার চেষ্টা করছে।
ক্ৰানা ও কাটুস্কার সঙ্গে তাদের ইনস্টিটিউটের আরো কিছু ছেলেমেয়ের দেখা হয়ে গেল। উত্তেজক এক ধরনের পানীয় খেতে খেতে তারা নাচানাচি করছে। দ্রীমানকে দেখে মনে হয় সে বুঝি এক পায়ে ভর দিয়ে অদৃশ্য কিছু একটা ধরার চেষ্টা করছে। ইনষ্টিটিউটের সবচেয়ে সুদর্শন এবং সবচেয়ে একরোখা উদ্ধত ছেলে মাজুর সঙ্গীতের তালে তালে নাচার চেষ্টা করছিল, কাটুস্কাকে দেখে হাত তুলে ডাকল, কাটুস্কা! এস, এক পাক নাচি।
কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, ইচ্ছে করছে না, মাজুর।
মাজুর অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, সে কী! সাইকাডোমে এডিফাসের কনসার্ট শুনতে এসে তুমি নাচবে না, সেটি কি হতে পারে?
কাটুস্কা উত্তরে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, ঠিক তখন স্টেজ থেকে গমগম করে একজনের কণ্ঠস্বর ভেসে এল, আমার প্রিয় ছেলে এবং মেয়েরা! তোমরা যার জন্য অপেক্ষা করছ, এই সময়ের সর্বশ্রেষ্ঠ গায়িকা তরুণ-তরুণীর হৃদয়ের ধন এডিফাস তোমাদের সামনে এসে উপস্থিত হচ্ছে। এ
তীব্র আলোর ঝলকানির সঙ্গে সঙ্গে সঙ্গীতের তীব্র ধ্বনিতে পুরো সাইকাডোম কেঁপে কেঁপে ওঠে এবং সবাই দেখতে পায় গোল স্টেজের ঠিক মাঝখানে স্বল্পবসনা একটি নারীমূর্তি ওপর থেকে নেমে আসছে। সাইকাডোমের হাজারখানেক ছেলেমেয়ে হাত তুলে চিৎকার করতে শুরু করে। স্বল্পবসনা এডিফাস তার হাতের শক্তিশালী লেজারের আলোতে সাইকাডোমের ছাদটি আলোকিত করে চিৎকার করে বলল, তোমরা কি তোমাদের মস্তিষ্কের ভেতর তীব্র আনন্দের অনুভূতির জন্ম দিতে প্রস্তুত?।
অসংখ্য ছেলেমেয়ে চিৎকার করে বলল, প্রস্তুত! প্রস্তুত!
তা হলে, চল। আমরা শুরু করি
উদ্দাম সঙ্গীতে পুরো সাইকাডোম প্রকম্পিত হয়ে ওঠে এবং তার সঙ্গে সঙ্গে সাইকাডোমের চারপাশে সাজিয়ে রাখা এন্টেনা থেকে মস্তিষ্কের ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির কাছাকাছি তীব্র ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন আসতে শুরু করে।
কাটুস্কা অবাক হয়ে দেখল প্রথমে তার বুকের ভেতর গভীর এক ধরনের বিষণ্ণতা ভর করে। সেই বিষণ্ণতা কেটে হঠাৎ করে তার এক ধরনের ফুরফুরে হালকা আনন্দ হতে থাকে। হালকা আনন্দটুকু হঠাৎ তীব্র এক ধরনের উল্লাসে রূপ নেয়। তার মনে হতে থাকে, পৃথিবীর কোনো কিছুতেই আর কিছু আসে যায় না। মনে হতে থাকে তার জন্ম হয়েছে সৃষ্টিছাড়া উদ্দাম বন্য আনন্দে মেতে ওঠার জন্য। সে চিৎকার করে মাথা দুলিয়ে সঙ্গীতের সঙ্গে সঙ্গে নাচতে শুরু করে। তার মনে হতে থাকে সাইকাডোমে হাজারখানেক নেশাগ্রস্ত তরুণ-তরুণীর উদ্দাম নৃত্যের বাইরে আর কিছু নেই। কখনো ছিল না, কখনো থাকবে না। তার মনে হতে থাকে সমস্ত বিশ্বব্রহ্মাণ্ড সঙ্কুচিত হয়ে এই সাইকাডোমে উপস্থিত হয়েছে। সব আনন্দ সব উল্লাস সাইকাডোমের চার দেয়ালের মাঝে আটকা পড়েছে। তার বাইরে আর কিছু নেই।
.
গভীর রাতে কাটুস্কা যখন নিজের এপার্টমেন্টে ফিরে আসছিল, তখন মাজুর জড়িত কণ্ঠে বলল, কী মজা হল তাই না, কাটুঙ্কা!
কাটুস্কার মাথা তখনো ঝিমঝিম করছিল, সে অন্যমনস্কর মতো বলল, হ্যাঁ।
মাজুর বলল, মানুষ হয়ে বেঁচে থাকা কী আনন্দের ব্যাপার। আমাদের কী সৌভাগ্য, আমরা মানুষ হয়ে জন্মেছিলাম।
কাটুস্কা হঠাৎ একটু আনমনা হয়ে যায়। সত্যিই কি তা-ই? সত্যিই কি সাইকাডোমে মস্তিষ্কে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স তৈরি করে উদ্দাম এক ধরনের সঙ্গীতের সঙ্গে লাফালাফি করাই জীবন?
মাজুর পা টেনে টেনে হাঁটতে হাঁটতে বলল, পৃথিবীতে আনন্দের এত কিছু আছে, একটা জীবনে সব শেষ করতে পারব বলে মনে হয় না।
কাটুস্কা তীক্ষ্ণ চোখে মাজুরের দিকে তাকিয়ে বলল, কী কী আনন্দের জিনিস আছে পৃথিবীতে?
সব কি বলে শেষ করা যাবে?
তবুও বল শুনি।
সঙ্গীত আছে, শিল্প আছে, সাহিত্য আছে। ভালো খাবার আছে, পানীয় আছে। মাদক আছে, এক শ রকম উত্তেজনা আছে। তবে–
তবে?
আমি শুনেছি, সবচেয়ে আনন্দের জিনিসটি হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে শিকার করা।
কাটুস্কা হাসার ভঙ্গি করে বলল, নির্বোধ মাছকে শিকার করার মধ্যে আনন্দ কোথায়?
মাজুর চোখ মটকে বলল, মাছ শিকার করবে কে বলেছে?
তা হলে কী শিকার করবে?
মানুষ। কাটুস্কা অবাক হয়ে বলল, মানুষ? কোন মানুষ?
জলমানব। ডলফিনের পিঠে করে তারা সমুদ্রের পানিতে ছুটে বেড়ায়। অসম্ভব হিংস্র। খুব ভালো হাতের টিপ না হলে ওদের মারা যায় না।
কী বলছ তুমি? জলমানব আবার কারা?
পৃথিবীটা যখন পানির তলায় ডুবে গিয়েছিল, তখন আমরা এই পাহাড়গুলোতে বসতি করেছি। পৃথিবীতে পাঁচ বিলিয়ন মানুষ তারা কোথায় যাবে? তারা সমুদ্রে গিয়েছে। তারা হচ্ছে জলমানব।
কিন্তু তারা তো সবাই সমুদ্রে ডুবে মারা গেছে।
মাজুর মাথা নাড়ল, সবাই মারা যায় নি। কিছু কিছু মানুষ বেঁচে গেছে।
কীভাবে বেঁচে গেছে? সমুদ্রে তারা কোথায় থাকে? কী করে? কী খায়?
জানি না। তবে তারা আছে। জংলি আর হিংস্র। পানিতে তারা হাঙরের থেকে হিংস্র। দশ হাজার ইউনিট দিলে তাদের শিকার করতে যাওয়া যায়। এর চেয়ে উত্তেজনার আর কিছু নেই পৃথিবীতে। আমি ইউনিট জমাচ্ছি, একদিন আমি যাব জলমানব শিকার করতে। মাজুর কাটুস্কার দিকে তাকাল, বলল, তুমি যেতে চাও?