তোমাদের ধন্যবাদ। কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, আমার এখন সম্ভবত তোমাদের উদ্দেশে কিছু একটা বলার কথা। আমি ঠিক জানি না, কী বলব! আজ থেকে কয়েক শ বছর আগে যখন মানুষেরা মাটির ওপরে থাকত, তখন পরিবার বলতে বোঝানো হত বাবা-মা আর ভারে সন্তানেরা। সমুদ্রের পানিতে যুদ্ধ করে বেঁচে থাকা। মানুষের জন্য পরিবার শব্দটা আরো ব্যাপক। এই ভাসমান দ্বীপের সব মানুষ মিলে আমরা একটি পরিবার। আমি তোমাদের কথা দিচ্ছি, আমাদের এই পরিবারটিকে আমি বুক আগলে রক্ষা করব।
সবাই হাত তুলে এক ধরনের আনন্দধ্বনি করল। কায়ীরা বলল, আমি জানি না, তোমরা টের পাচ্ছ কি না, সমুদ্রের আবহাওয়া খুব দ্রুত পাল্টে যাচ্ছে। একটা খুব বড় টাইফুন আসছে। আমরা কিছু বোঝার আগেই এই টাইফুন এসে আমাদের আঘাত করবে। তাই আমার মনে হয়, আমরা আমাদের কাজ রু করে দিই।
সবাই মাথা নাড়ল। কায়ীরা নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি তোমাদের দশজনকে নিয়ে এই মুহূর্তে বের হয়ে যাও। যারা গভীর সমুদ্রে গেছে তাদের ফিরে আসতে বল।
নিহন মাথা নেড়ে বলল, ঠিক আছে।
কায়ীরা কমবয়সী একটা মেয়েকে বলল, ক্রিটিনা, তুমি ন্যাদা বাচ্চাগুলো একত্র করে পানির নিচে ওদের অক্সিজেন সাপ্লাই দেওয়ার ব্যবস্থাটা নিশ্চিত কর।
ক্রিটিনা অবাক হয়ে বলল, ওরা আমাদের সঙ্গে থাকবে না?
থাকবে। কিন্তু নিজেদের অক্সিজেন সাপ্লাইসহ। আমি শিশুদের নিয়ে ঝুঁকি নেব না। কায়ীরা ঘুরে মধ্যবয়স্ক রিতুনকে বলল, রিতুন, তুমি তোমার ইঞ্জিনিয়ার টিম নিয়ে এখনই পাম্পগুলোর কাছে যাও। দেখ, সেগুলো কাজ করছে কি না। তেলের সাপ্লাই ঠিক কর। দরকার হলে রিজার্ভ থেকে বের কর।
ঠিক আছে।
কায়ীরা আরো কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল, ঘুরে নিহনের দিকে তাকাল, বলল, নিহন, তুমি এক্ষুনি যাও দাঁড়িয়ে থেকো না। আমাদের হাতে সময় নেই। আমার কথা বিশ্বাস না হলে আকাশের দিকে তাকিয়ে দেখ।
নিহন আকাশের দিকে তাকাল, সত্যি সত্যি সেখানে ধূসর এক ধরনের মেঘ এসে জমা হচ্ছে। কেমন যেন থমথমে পরিবেশ। সে উঠে দাঁড়ায়, বলে, কায়ীরা, আমি যাচ্ছি, আমি এক্ষুনি যাচ্ছি।
০২. কাটুস্কা একদৃষ্টে মনিটরটির দিকে
কাটুস্কা একদৃষ্টে মনিটরটির দিকে তাকিয়ে ছিল। উপগ্রহ থেকে সরাসরি ছবি পাঠিয়েছে- সেই ছবিতে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে সমুদ্রের বুকে একটা টাইফুন তৈরি হচ্ছে। নীল সমুদ্রের ওপর সাদা মেঘের ঘূর্ণন, কী প্রচণ্ড শক্তি না জানি তার মাঝে জমা হয়ে আছে। টাইফুনটি
এখন সমুদ্রের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াবে, সমুদ্রের নীল পানিকে ওলটপালট করে দিয়ে একদিক থেকে অন্যদিকে ছুটে যাবে! কাটুস্কা মনিটর থেকে চোখ ফেরাতে পারে না, মনে হয় প্রকৃতি ভয়ঙ্কর ক্রোধে ফুঁসে উঠছে, এই ক্রোধের মাঝেও যে এক ধরনের সৌন্দর্য লুকিয়ে থাকতে পারে সেটি নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা যায় না।
ঘরের দরজায় কে জানি টুকটুক করে শব্দ করল। কাটুস্কা মনিটর থেকে চোখ সরিয়ে বলল, কে?
দরজাটা একটু খুলে কাটুস্কার সমবয়সী একটি মেয়ে ঘরের ভেতরে মাথা ঢুকিয়ে বলল, আমি, কানা।
ও! ক্রানা, এস, ভেতরে এস।
তুমি একা একা বসে কী করছ? ভিডি টিউবে ভালো কিছু দেখাচ্ছে নাকি?
না না, সেসব কিছু না। আমি উপগ্রহের একটা ছবি দেখছিলাম। ক্ৰা
না কাটুস্কার কাছাকাছি এসে জিজ্ঞেস করল, কিসের ছবি?
টাইফুনের। সমুদ্রের ওপর একটা টাইফুন তৈরি হচ্ছে। তাই দেখছি।
ও! তাই নাকি? ক্রানা ব্যাপারটাতে কোনো কৌতূহল দেখাল না। হাজার হাজার মাইল দূরে সমুদ্রে টাইফুন নিয়ে এখানে কেউ মাথা ঘামায় না। সে মাথা ঝাঁকিয়ে জিজ্ঞেস করল, এখানে বসে থাকবে, নাকি বের হবে?
কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বুঝতে পারছি না। মনে হয় বের হব।
ক্ৰানা একটু অবাক হয়ে বলল, আচ্ছা কাটুস্কা, তোমার হয়েছেটা কী?
কাটুস্কা জোর করে মুখে হাসি টেনে বলল, কী হবে? কিছু হয় নি।
তোমার বয়সী একটা মেয়ের এ রকম গম্ভীর মুখে থাকার কথা না।
কাটুস্কা গম্ভীর মুখে বলল, আমি মোটেও গম্ভীর মুখে থাকি না।
কাটুস্কার কথা শুনে ক্ৰানা শব্দ করে হেসে উঠে বলল, ঠিক আছে, তুমি গম্ভীর মুখে থাক না! এখন চল।
কোথায়?
সাইকাডোমে এডিফাসের কনসার্ট।
এডিফাসটি কে?
ক্ৰানা চোখ কপালে তুলে বলল, তুমি এডিফাসের নাম শোন নি? তার গান শুনে সব ছেলেমেয়ে পাগল হয়ে যাচ্ছে। আর তুমি তার নাম শোন নি?
খুব ভালো গান গায়?
তা না হলে মানুষ তার জন্য এত পাগল হবে কেন? গান থেকেও বড় ব্যাপার আছে।
সেটা কী?
পুরো সাইকাডোমে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেজোনেন্স তৈরি করে। আমাদের মস্তিষ্কের ন্যাচারাল ফ্রিকোয়েন্সির সাথে মিলিয়ে দেয়, তখন অপূর্ব এক ধরনের অনুভূতি হয়।
কাটুস্কা অবাক হওয়ার ভঙ্গি করে বলল, সত্যি?
হ্যাঁ, দ্রীমান বলেছে আমাকে।
কাটুস্কা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, দ্রীমান সব সময়েই একটু বাড়িয়ে-চাড়িয়ে কথা বলে। তার সব কথা বিশ্বাস কোরো না।
ক্ৰানা মাথা নাড়ল, বলল, আমি সেটা জানি।
দুই বান্ধবী যখন সাইকাডোমে পৌঁছেছে তখন সেখানে এর মাঝেই হাজারখানেক কমবয়সী ছেলেমেয়ে উপস্থিত হয়ে গেছে। এই বয়সী ছেলেমেয়েরা নিয়ম ভাঙতে পছন্দ করে, তাই তাদের পোশাকে ছিরিছাদ নেই। চোখে-মুখে-চুলে নানা ধরনের রঙ। কথাবার্তা, চালচলনে এক ধরনের অস্থিরতা।