তুমি সেটা নিয়ে চিন্তা কোরো না, আমি নৌকার মালিককে খুঁজে বের করে তাকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দেব।
তোমাকে অনেক ধন্যবাদ কাটুঙ্কা। অনেক ধন্যবাদ।
নিহন আকাশের দিকে তাকাল, তারপর সমুদ্রের পানির দিকে তাকাল, কান পেতে কিছু একটা শুনল, তারপর ঘুরে কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, আমার মনে হয় এখন রওনা দিয়ে দেওয়া উচিত। বাতাসের শব্দ শুনছ? এই বাতাসে পাল তুলে দিলে আমি দেখতে দেখতে সমুদ্রের স্রোতে পৌঁছে যাব।
কাটুস্কা কিছু বলল না। নিহন বলল, তোমাকে যে আমি কী বলে ধন্যবাদ দেব জানি না। তুমি আমাকে সাহায্য না করলে আমি কোন দিন এখান থেকে যেতে পারতাম না।
কাটুস্কা এবারো কোনো কথা বলল না। নিহন বলল, এখন অনেক রাত। তুমি ফিরে যাও, কাটুস্কা। তোমাকে নিশ্চয়ই সবাই খুঁজছে।
হ্যাঁ। যাই। কাটুস্কা খুব সাবধানে নিহনের মুখমণ্ডল স্পর্শ করে বলল, তুমিও যাও। খুব সাবধানে যেও।
যাব।
আমার কথা মনে রেখ।
মনে রাখব, কাটুস্কা।
তোমার অনেক কষ্ট হল, তাই না?
না, আমার কোনো কষ্ট হয় নি।
আমরা তোমাদের পানিতে ঠেলে দিয়ে খুব অন্যায় করেছিলাম। অথচ-
অথচ কী?
অথচ তোমরাই ভালো আছ। আমরা ধীরে ধীরে শেষ হয়ে যাচ্ছি।
এ রকম কথা কেন বলছ?
কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলে, আমার খুব কাছের বন্ধুরা আত্মহত্যা করেছে। যারা করে নি তাদের বেশিরভাগ নেশায় ডুবে থাকে। বাকি যারা আছে তারা ভান করে যে খুব ভালো আছে, আসলে কেউ ভালো নেই। তারা সব সময় বলে এই জীবনের কোনো অর্থ নেই। এর থেকে মরে যাওয়া ভালো।
কী বলছ তুমি?
কাটুস্কা বলল, হ্যাঁ, সত্যি বলছি। আমাদের কোনো ভবিষ্যৎ নেই। আমাদের দেখার মতো কোনো স্বপ্ন নেই। আমরা কেন বেঁচে আছি জানি না। নিহন, তোমাকে দেখে আমার যে কী হিংসা হচ্ছে তুমি জান?
কেন, কাটুস্কা?
চাঁদের আলোতে উত্তাল সমুদ্রে তুমি এই ছোট নৌকায় পাল উড়িয়ে যাবে। সমুদ্রের মাছ, লতাপাতা তোমার খাবার-সমুদ্রের পানি তোমার আশ্রয়। ডলফিনেরা এসে তোমার সঙ্গে কথা বলবে-যখন তোমার এলাকায় পৌঁছাবে সেখানে তোমার আপনজনেরা তোমার জন্য অপেক্ষা করছে। কোনো একটা রূপবতী মেয়ে হয়তো ছুটে এসে তোমার বুকে মাথা গুঁজে ভেউ ভেউ করে কাঁদবে? কাঁদবে না?
না। কাঁদবে না। আমার আপনজনেরা আমার কাছে ছুটে আসবে, কিন্তু কোনো রূপবতী মেয়ে আমার কাছে আলাদা করে ছুটে আসবে না।
আমি যদি একজন জলমানবী হতাম তা হলে আমি তোমার কাছে ছুটে যেতাম।
নিহন কোনো কথা বলল না। কাটুস্কা ফিসফিস করে বলল, আমার কী ইচ্ছে করছে তোমার সঙ্গে যেতে! ইস! আমি যদি তোমার মতো জলমানব হয়ে যেতে পারতাম!
.
কাটুস্কা জলমানব হতে পারল না। সে সমুদ্রের তীরে দাঁড়িয়ে রইল-সমুদ্রের ঢেউ তার পা ভিজিয়ে দিচ্ছিল। বাতাসে হাহাকারের মতো এক ধরনের শব্দ, মনে হয় কেউ বুঝি করুণ স্বরে কাঁদছে। চাঁদের আলোতে দেখা যাচ্ছে ছোট একটা নৌকা পাল উড়িয়ে যাচ্ছে। সেই নৌকায় অসম্ভব রূপবান একজন জলমানব ধীরে ধীরে সমুদ্রের গভীরে অদৃশ্য হয়ে যেতে থাকে। সে কি চিৎকার করে ডাকবে এই রূপবান তরুণটিকে, কাতর গলায় অনুনয় করে বলবে, তুমি আমাকে নিয়ে যাও! আমাকে নিয়ে যাও তোমার সাথে!
কাটুস্কা ডাকল না, ডাকলেও সমুদ্রের উথাল-পাথাল বাতাসে সেই ডাকটি কেউ শুনতে পেত না।
» ১৩. সমুদ্রের নীল পানিতে
সমুদ্রের নীল পানিতে ছোট একটা নৌকা ভেসে যাচ্ছে। চারপাশে অথই জলরাশি তার কোনো শুরু নেই কোনো শেষ নেই। নৌকার হাল ধরে নিহন মৃদু স্বরে গান গায়, বিরহিণী একটা মেয়ের গান। মেয়েটি ঘরের দরজায় মাথা হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে, তার প্রিয়তম নৌকা নিয়ে সমুদ্রে গিয়েছে কখন ফিরে আসবে সে জানে না। আকাশ কালো করে মেঘ আসছে, সমুদ্রের নীল জল ধূসর হয়ে ফুঁসে উঠছে, কিন্তু দিগন্তে এখনো তো নৌকার মাস্তুল ভেসে উঠছে না। মেয়েটির বুকে অশুভ আশঙ্কার ছায়া, দরজায় মাথা রেখে ভাবছে তার প্রিয়তম ফিরে আসতে পারবে কি? নিহন কোথায় শিখেছে এই গানের কলি? শিখেছে কি কখনো?
অন্ধকার নেমে এলে আকাশের নক্ষত্রেরা পরম নির্ভরতায় তার দিকে তাকিয়ে থাকে। তার চেনা নক্ষত্রগুলো পুব আকাশে উঠে সারা রাত তাকে চোখে চোখ রেখে সূর্য ওঠার আগে অদৃশ্য হয়ে যায়। তোরবেলা সূর্যের নরম আলো ভালবাসার হাত বাড়িয়ে দেয় নিহনের দিকে।
নিহন নৌকার হাল ধরে বসে থাকে। আন্তঃমহাসাগরীয় স্রোত তাকে ভাসিয়ে ভাসিয়ে নিয়ে যায়। কত দিন সে ভাসবে এভাবে?
দরজায় শব্দ শুনে কায়ীরা চোখ মেলে তাকাল। এত রাতে কে এসেছে?
কায়ীরা দেয়ালে ঝুলিয়ে রাখা চাঁদরটা নিজের গায়ে জড়িয়ে দরজা খুলে বাইরে এল। অন্ধকারে ছায়ামূর্তির মতো কে যেন দাঁড়িয়ে আছে, কায়ীরা অবাক হয়ে বলল, কে?
আমি। আমি নিহন।
নিহন! কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত কথা বলতে পারে না। কাছে গিয়ে তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে রাখে। যেন ছেড়ে দিলেই সে হারিয়ে যাবে। জ্যোৎস্নার মান আলোতে নিহনকে দেখার চেষ্টা করল, বলল, তুমি কখন এসেছ, নিহন।
এই তো। এখন।
তুমি কেমন ছিলে, নিহন? তোমাকে নিয়ে আমরা এত ভাবনায় ছিলাম! তোমাকে আমরা কখনো ফিরে পাব সেটা ভাবি নি, নিহন।
চাঁদের স্নান আলোতে নিহন মৃদু হাসল, বলল, আমিও ভাবি নি আমি কখনো ফিরে আসব।