উপস্থিত মানুষগুলোর মধ্যে একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে আবার থেমে গেল। রিসি বুড়ো তার নিষ্প্রভ চোখ দুটো দিয়ে সবাইকে দেখার চেষ্টা করতে করতে বলল, কেন ডেকেছি তোমরা জান?
কাছাকাছি বসে থাকা একটি মেয়ে তার কাপড় বোনার কাঁটা দুটো পাশে সরিয়ে রেখে বলল, নেপচুনের দোহাই-টাইফুন আসছে বলার জন্য ডাক নি তো?
হা, টাইফুন আসছে, কিন্তু আমি সেজন্য তোমাদের ডাকি নি। আমি তার থেকে গুরুত্বপূর্ণ একটা কথা বলার জন্য তোমাদের ডেকেছি।
কায়ীরা একটু অবাক হয়ে রিসি বুড়োর দিকে তাকাল। আট থেকে দশ মাত্রার টাইফুন থেকে গুরুত্বপূর্ণ কী কথা তার বলার আছে? ভ
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ শরীরটি সোজা করে বসার চেষ্টা করে বলল, তোমরা সবাই জান, আমার বয়স হয়েছে। চোখ দিয়ে বলতে গেলে কিছু দেখি না। ভালো করে শুনতেও পাই না। সহজ কথাটাও মনে থাকে না, ভুলে যাই। তোমাদের দেখলে চিনতে পারি না। এসব দেখে আমি বুঝতে পারছি আমার অতল সমুদ্রের ডাক আসছে।
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস নেওয়ার জন্য এক মুহূর্ত থামল, সবার ভেতরে এক মুহূর্তের জন্য একটা গুঞ্জন শুরু হয়ে সেটা আবার সাথে সাথে থেমে গেল। বুড়ো রিসি মাথা তুলে বলল, প্রায় বিশ বছর আগে কাতুল মারা যাওয়ার পর আমি তোমাদের দায়িত্ব নিয়েছিলাম। দুঃখে-কষ্টে সুখে-দুঃখে সারাক্ষণ আমি তোমাদের সঙ্গে ছিলাম। আমি তোমাদের কথা শুনেছি, তোমরাও আমার কথা শুনেছ।
গত কিছুদিন থেকে আমি বুঝতে পারছিলাম এখন আমার বিদায় নেওয়ার সময় হয়েছে। অন্য একজনকে এখন তোমাদের নেতৃত্ব দেওয়ার দায়িত্ব নিতে হবে। কাকে সেই দায়িত্ব দেওয়া যায় আমি সেটা বুঝতে পারছিলাম না। আমি মনে মনে সেই মানুষটিকে খুঁজছিলাম। কিন্তু খুঁজে পাচ্ছিলাম না।
রিসি বুড়ো এক মুহূর্তের জন্য থেমে তার নিষ্প্রভ দৃষ্টিতে সবার দিকে তাকায়, তারপর গলায় একটু জোর দিয়ে বলল, আমি অল্প কিছুক্ষণ আগে সেই মানুষটিকে খুঁজে পেয়েছি। সেই মানুষটির কাছে আমার সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দেওয়ার জন্য আমি এখন তোমাদের এখানে ডেকেছি।
ছড়িয়ে-ছিটিয়ে বসে থাকা মানুষগুলো এবারে উত্তেজনায় হট্টগোল শুরু করে দেয়। রিসি বুড়ো সবাইকে থেমে যাওয়ার জন্য সময় দেয়। হট্টগোল এবং গুঞ্জন থেমে যাওয়ার পর রিসি বুড়ো আবার মুখ খুলল, বলল, পৃথিবীর স্থলমানবেরা যখন আমাদের সমুদ্রের মধ্যে ঠেলে দিয়েছিল, তখন সবাই ভেবেছিল আমরা শেষ হয়ে যাব। আমরা শেষ হয়ে যাই। নাই এবং এখন মনে হচ্ছে সমুদ্রের পানিতে বেঁচে থেকে আমরা একটা নূতন সভ্যতা তৈরি করতে যাচ্ছি। তার একটা কারণ, আমরা কখনো নেতৃত্ব নেওয়ার জন্য ব্যস্ত হই না। যে নেতৃত্ব নেওয়ার যোগ্য আমরা তার হাতে সেটা তুলে দিই। আমি আজ সেই নেতৃত্বটি তোমাদের একজনের হাতে তুলে দেব। আমাদের জলমানবের ইতিহাস আর ঐতিহ্য অনুযায়ী তোমরা সবাই তাকে অভিনন্দন জানাও।
চকচকে উত্তেজিত চোখে অনেকে উঠে দাঁড়িয়ে গেল, চিৎকার করে বলল, কে? কে? কে নূতন নেতা?
রিসি বুড়ো ধীরে ধীরে সামুদ্রিক কচ্ছপের ফাঁকা খোলসটা থেকে বের হয়ে আসে, নিজের গলা থেকে জেড পাথরের মালাটি খুলে নিয়ে নরম গলায় ডাকল, কায়ীরা, তুমি সবার সামনে এসে দাঁড়াও।
উপস্থিত মানুষগুলো উত্তেজনায় চিৎকার করতে থাকে, কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী কয়েকটি মেয়ে কায়ীরাকে জড়িয়ে ধরে। কায়ীরা তাদের ভালবাসার আলিঙ্গন। থেকে নিজেকে মুক্ত করে রিসি বুড়োর সামনে গিয়ে দাঁড়াল।
রিসি বুড়ো সস্নেহে কায়ীরার দিকে তাকিয়ে বলল, এস কায়ীরা। তোমার দায়িত্বটুকু বুঝে নাও।
কায়ীরা নিচু গলায় বলল, জেড পাথরের এই মালাটা আমার গলায় পরিয়ে দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার জীবনটা অন্য রকম হয়ে যাবে।
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ কায়ীরা।
তুমি ঠিক করে পুরো ব্যাপারটা ভেবেছ? সত্যিই তুমি আমাকে দায়িত্ব দিতে চাও?
হ্যাঁ কায়ীরা। এই পুরো দ্বীপটিতে শুধু তুমিই এই টাইফুনের কথা বুঝতে পেরেছ। আর কেউ পারে নি।
নেতা হওয়ার জন্য সেটাই কি যথেষ্ট?
না কায়ীরা, সেটা যথেষ্ট না। আরো কী দরকার আমি সেটা জানি। আমি বিশ বছর থেকে সেটা করে আসছি।
তুমি নিশ্চিত, তুমি ভুল করছ না?
আমি নিশ্চিত কায়ীরা। তুমি জান, গত বিশ বছরে আমি একবারও ভুল সিদ্ধান্ত নিই নি।
বেশ। কায়ীরা নিঃশ্বাস ফেলে রিসি বুড়োর সামনে মাথা নিচু করে দাঁড়াল। রিসি বুড়া জেড পাথরের মালাটি কায়ীরার গলায় পরিয়ে দিয়ে শীর্ণ হাতে তার মাথা স্পর্শ করে বলল, তুমি আমাদের জন্য একটা নূতন সভ্যতার জন্ম দাও কায়ীরা।
কায়ীরা ফিসফিস করে বলল, যদি সেটাই আমাদের ভবিষ্যৎ হয়ে থাকে তা হলে আমি সেটাই করব, রিসি বুড়ো।
ধন্যবাদ কায়ীরা। রিসি বুড়ো একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কায়ীরা এবারে ঘুরে সবার দিকে তাকাল। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তখন হাত নাড়ছে, চিৎকার করছে। সে হাত তুলতেই সবাই চুপ করে যায়। কায়ীরা একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমি কখনো ভাবি নি আমাকে এই দায়িত্ব নিতে হবে।
কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা কমবয়সী একটা মেয়ে বলল, তুমি খুব চমৎকারভাবে এই দায়িত্ব পালন করবে, কায়ীরা।
মধ্যবয়সী একজন মানুষ বলল, আমাদের সবার পক্ষ থেকে তোমাকে অভিনন্দন।