নিহন মাথা নেড়ে বলল, তুমি কেমন করে এটা আগে থেকে বুঝতে পার আমি বুঝি না!
কায়ীরা বলল, একসময় পৃথিবীতে হাজারো রকম যন্ত্রপাতি থাকত, মানুষ সেগুলো দেখে বলতে পারত। এখন যন্ত্রপাতি নেই, তাই আগে থেকে অনুমান করতে হয়-
যন্ত্রপাতি নেই সেটা তো সত্যি নয় নিহন ইতস্তত করে বলল, যন্ত্রপাতি আছে। আমাদের কাছে নেই। স্থলমানদের কাছে আছে।
কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকাল, তোমার কি ধারণা, স্থলমানবেরা কোনো দিন সেই যন্ত্রপাতিগুলো নিয়ে এসে আমাদের বলবে, নাও এই যন্ত্রপাতিগুলো নাও?
নিহন বলল, না, তা আমি বলছি না।
এই টাইফুন আমাদের জন্য যত বড় বিপদ, তার চেয়ে অনেক বড় বিপদ এই স্থলমানবেরা। আমরা যদি কোনো দিন পৃথিবী থেকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাই, তা হলে সেটা টাইফুনের জন্য হবে না, রোগ-শোক-মহামারীর জন্য হবে না, সেটা হবে এই স্থলমানদের জন্য! বুঝেছ? তারা কোনো একদিন এসে আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারে।
নিহন একটু অস্থির হয়ে বলল, কিন্তু কায়ীরা, আমি এই একটা জিনিস বুঝতে পারি। আমরা যেরকম মানুষ তারাও ঠিক সেরকম মানুষ। কিন্তু তারা কেন আমাদের নিশ্চিহ্ন করে দিতে চাইবে? একসময় তো আমরা সবাই একসঙ্গে ছিলাম
পৃথিবীটা পানির নিচে ডুবে সব হিসাব অন্য রকম হয়ে গেছে!
নিহন মাথা ঘুরিয়ে সমুদ্রটির দিকে তাকায়, চারিদিকে শুধু পানি আর পানি। একসময় পৃথিবীতে মাটি ছিল। এখন নেই। সব এই সমুদ্রের নিচে তলিয়ে গেছে। ছিটেফোঁটা যেটুকু তলিয়ে যায় নি সেখানে স্থলমানবেরা থাকে। আর তারা থাকে সমুদ্রের পানিতে। তাদের জন্য একটা নূতন নাম হয়েছে, জলমানব। পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে প্রায় দুই শ বছর আগে, জলমানব আর স্থলমানব!
কারীরা একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, যদি কখনো ঠিক করে এই পৃথিবীর ইতিহাস লেখা হয় তখন সেখানে কী লেখা হবে জান?
কী?
সেখানে লেখা হবে এই পৃথিবীর সবচেয়ে চমকপ্রদ ব্যাপার হচ্ছে আমাদের টিকে থাকা! শুকনোতে থাকা স্বার্থপর মানুষগুলো দুই শ বছর আগে যখন আমাদের পানিতে ঠেলে দিয়েছিল তখন আমাদের টিকে থাকার কথা ছিল না। কিন্তু আমরা টিকে গিয়েছি।
নিহন অন্যমনস্কের মতো মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ টিকে গিয়েছি। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমাদের কোনো জ্ঞান-বিজ্ঞান নেই, কোনো প্রযুক্তি নেই-
কে বলেছে নেই?
স্থলমানবেরা কত কিছু করে। মহাকাশে রকেট পাঠায়। আকাশে ওড়ে, কত রকম আনন্দ-ফুর্তি করে! আর আমরা? শুধু কোনোভাবে বেঁচে আছি।
কায়ীরা বিচিত্র একটা দৃষ্টিতে নিহনের দিকে তাকিয়ে রইল। নিহন বলল, কী হল, তুমি কিছু বলছ না কেন?
আমি ইচ্ছে করলেই বলতে পারি। কিন্তু আমি নিজে থেকে বলতে চাই না। তোমার নিজেকে সেটা বুঝতে হবে। আমরা এমনি এমনি টিকে নেই নিহন, আমরা টিকে আছি। আমাদের নিজস্ব জ্ঞান-বিজ্ঞানের জন্য। সেই জ্ঞান-বিজ্ঞানটা কী জান?
কী?
সেটা আমি তোমাকে বলব না। সেটা তোমাকে বের করতে হবে।
নিহন মাথা চুলকে বলল, আমাদের ইলেকট্রিক জেনারেটর? অক্সিজেন টিউব? পানির পাম্পমেশিন?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, না। এগুলো ছোটখাটো ব্যাপার। এর চেয়ে অনেক বড় বিজ্ঞান, অনেক বড় প্রযুক্তি আমাদের আছে!
সেটা কী?
কায়ীরা এক ধরনের রহস্যের ভাব করে বলল, সেটা আমি তোমাকে বলব না। তোমার নিজেকে এটা বের করতে হবে।
নিহন কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, কায়ীরা তাকে থামিয়ে দিয়ে বলল, এখন চল, অনেক কাজ আছে। দেখি রিসি বুড়ো কী বলে?
.
বিশাল একটা সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলসের ভেতর রিসি বুড়ো গুটিসুটি মেরে বসে ছিল। কায়ীরা আর নিহনের পায়ের শব্দ শুনে বলল, কে?
কায়ীরা বলল, আমি রিসি বুড়ো। আমি আর নিহন।
নিহন? নিহনটা কে?
ক্রাচিনার বড় ছেলে।
ও। রিসি বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, কাচিনার বাপ খুব সাহসী মানুষ ছিল। স্থলমানবের সঙ্গে একবার সে একা যুদ্ধ করেছিল। একেবারে ফাটাফাটি যুদ্ধ।
নিহন সেই গল্প অনেকবার শুনেছে। তাকেও কোনো দিন তার পূর্বপুরুষের মতো স্থলমানবের সঙ্গে যুদ্ধ করতে হবে কি না কে জানে!
কায়ীরা বলল, বাতাসটা টের পাচ্ছ রিসি বুড়ো?
বুড়ো হয়েছি, আগের মতো টের পাই না। তবু মনে হচ্ছে গোলমাল।
মনে হয় টাইফুন আসছে।
রিসি বুড়ো মাথা নাড়ল, বলল, খা। মনে হয় বড় একটা আসছে।
বছরের শুরুতেই এ রকম, পরে কী হবে?
রিসি বুড়ো বিড়বিড় করে বলল, সবকিছু ওলটপালট হয়ে গেছে। কোনো কিছুর আর হিসাব মেলে না!
আমাদের তো কাজ শুরু করে দিতে হবে।
হ্যাঁ, দিতে হবে।
সবাইকে ডাকব?
রিসি বুড়ো নিঃশ্বাস ফেলে বলল, ডাক।
কিছুক্ষণের মধ্যেই ভাসমান দ্বীপের মানুষেরা বিসি বুড়োর কাছে হাজির হতে শুরু করে। প্রত্যেকটা পরিবার থেকে একজন আসার কথা, যারা মাছ ধরতে বা অন্য কাজে সমুদ্রে। গিয়েছে শুধু তারা আসতে পারে নি। তারপরও প্রায় দুই শ পুরুষ আর মহিলা হাজির হয়েছে। যারা এসেছে তারা কেউই বসে নেই, মেয়েরা সামুদ্রিক শ্যাওলার সুতো দিয়ে কাপড় বুনছে। পুরুষেরা পাথরের টুকরোয় হাঙরের দাঁত ঘষে ধারালো করে তুলতে তুলতে নিচু গলায় কথা বলছে। তাদের অনেকেরই উদোম শরীর, শক্ত পেশিবহুল শরীর, রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে আছে।
রিসি বুড়ো তার শীর্ণ হাত ওপরে তুলতেই সবাই কথা বন্ধ করে মাথা তুলে তাকাল। রিসি বুড়ো গলা উঁচিয়ে বলল, তোমরা নিশ্চয়ই অনুমান করতে পারছ আমি তোমাদের কেন ডেকেছি।