কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা একজন জিজ্ঞেস করল, কে দেখেছে?
তাহা পরিবার মাছ ধরতে গিয়েছিল, তারা এসে বলেছে।
কোন দিকে যাচ্ছে?
এখন বোঝা যাচ্ছে না।
নিহন কাছাকাছি দাঁড়িয়ে ছিল, জিজ্ঞেস করল, কায়ীরা, ইয়টে করে স্থলমানবেরা কেন এসেছে বলে মনে হয়?
কায়ীরা একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, আনন্দ করতে এসেছে। স্ফুর্তি করতে এসেছে।
তারা কেমন করে স্ফুর্তি করে?
ইয়টের ডেকে বসে তারা খায়-দায় আনন্দ করে। নাচানাচি করে। মাঝে মধ্যে শিকার করে।
কী শিকার করে?
পাখি, মাছ, ডলফিন। একবার শুনেছিলাম-
কী শুনেছিলে?
কায়ীরা ইতস্তত করে বলল, আমি ব্যাপারটায় কখনো পুরোপুরি নিশ্চিত হতে পারি নি। ভাসা ভাসাভাবে শুনেছি
কী শুনেছ?
তারা নাকি দুই-একজন মানুষকে গুলি করে মেরে ফেলেছিল। আমাদের মতো মানুষ।
নিহন চমকে উঠে বলল, আনন্দ করার জন্যে তারা মানুষ মারে?
আনন্দ করার জন্যে মেরেছে নাকি অন্য কোনো কারণ ছিল আমি জানি না। যে কলোনির মানুষকে মেরেছে তাদের সঙ্গে আমার কখনো কথা হয় নি।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ বলল, কায়ীরা।
বল।
আমাদের কি একটু সতর্ক থাকা দরকার?
হ্যাঁ।
কীভাবে সতর্ক থাকব?
ওদের কাছাকাছি হতে চাই না।
যদি কাছাকাছি চলে আসে?
আসার কথা নয়। কায়ীরা মাথা নেড়ে বলল, কখনো আসে না। কিন্তু তারপরও যদি চলে আসে আমরা সরে যাব। নৌকায় ডলফিনে সবাই ছড়িয়ে-ছিটিয়ে সরে যাব।
মধ্যবয়স্ক মানুষটি বলল, আমি কি সবাইকে একটু সতর্ক করে রাখব? এখনই না। শুধু শুধু ভয় দেখিয়ে লাভ নেই। আমরা একটু দেখি ইয়টটা কোন দিকে যায়।
কায়ীরা নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি ইয়টটাকে চোখে চোখে রাখতে পারবে?
পারব, কায়ীরা।
একেবারেই কাছে যাবে না। অনেক দূরে থাকবে।
ঠিক আছে। অনেক দূরে থাকব।
মনে রেখ ওরা কিন্তু বাইনোকুলার দিয়ে অনেক দূরে দেখতে পাবে।
নিহন মাথা নাড়ল, হ্যাঁ জানি।
তা হলে তুমি যাও। সঙ্গে কতজনকে নিতে চাও?
যত কম নেওয়া যায়। সবচেয়ে ভালো হয় একা গেলে, যদি নিতেই হয় তা হলে আর একজন।
আমি যাব নিহনের সঙ্গে আমি। কিশোরী গলার স্বর শুনে সবাই ঘুরে তাকাল, নাইনা নামের ছিপছিপে মেয়েটি সবাইকে ঠেলে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে।
কায়ীরা মুখের হাসি গোপন করে বলল, তুমি?
হ্যাঁ, কায়ীরা আমি।
তুমি এই কাজের জন্য খুব ছোট।
না কায়ীরা- নাইনা তার কুচকুচে কালো চুল কঁকিয়ে প্রতিবাদ করে বলল, আমি ছোট না। আমি সমুদ্রের তল থেকে এনিমম তুলে এনেছি। আমার ডলফিন কিকি আমাকে নিয়ে এক শ কিলোমিটার চলে যেতে পারে, আমি হাঙর শিকার করেছি, নীল তিমির দুধ দুয়েছি।
ব্যস! ব্যস! অনেক হয়েছে- কায়ীরা হেসে নাইনাকে থামিয়ে দিল। বলল, আমাদের কিছু নিয়মকানুন আছে। ছোট কিংবা বড় বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ না- কার কতটুকু অভিজ্ঞতা সেটা হচ্ছে গুরুত্বপূর্ণ।
আমাকে যদি যেতে না দাও আমার অভিজ্ঞতা হবে কেমন করে?
ঠিক আছে, আমি অনুমতি দিচ্ছি।
নাইনা আনন্দের একটা শব্দ করতে যাচ্ছিল, কায়ীরা হাত তুলে তাকে থামিয়ে দিল, বলল, তুমি যেহেতু যথেষ্ট বড় হও নি আমার অনুমতি যথেষ্ট নয়। তোমার বাবা-মায়ের অনুমতি ছাড়া তোমাকে পাঠানো যাবে না!
নাইনা একটা হতাশার মতো শব্দ করে কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা তার মায়ের দিকে তাকাল, চোখে-মুখে একটা করুণ ভাব ফুটিয়ে তুলে বলল, মা
নাইনার মা বলল, তুই এতটুকুন মেয়ে কোথায় একটু লেখাপড়া করবি, ঘরের কাজ শিখবি তা না দিনরাত দস্যিপনা। সমুদ্রের পানি ছাড়া আর কিছু বুঝিস না।
নাইনা প্রতিবাদ করে বলল, কে বলেছে আর কিছু বুঝি না। আমি ত্রিঘাত সমীকরণ শেষ করেছি মা। আমি আমার ক্লাসে জীববিজ্ঞানে সবচেয়ে বেশি নম্বর পেয়েছি। আমি নীল তিমির চর্বি থেকে জ্বালানি তেল তৈরি করতে পারি। সামুদ্রিক শ্যাওলা থেকে কাপড় বুনতে পারি।
ঠিক আছে, বাবা ঠিক আছে। নাইনার মা হাল ছেড়ে দিয়ে বলল, তুই যেতে চাইলে যা। কিন্তু খুব সাবধান।
নাইনা এবার আনন্দের মতো একটা শব্দ করল। নিহন নাইনার মাথার চুল এলোমেলো করে দিয়ে বলল, নাইনা! আমি তোমার কাজকর্মের মাথামুণ্ডু কিছু বুঝতে পারি না। যে কাজ থেকে সবাই সরে থাকতে চায় তুমি সেই কাজে ঝাঁপিয়ে পড়তে চাও! কারণটা কী?
নাইনা দাঁত বের করে হেসে বলল, আমার মাথাটা মনে হয় একটু খারাপ!
নাইনার মা বলল, হ্যাঁ। আসলে তা-ই। তোর আসলেই মাথা খারাপ। তারপর নিহনের দিকে তাকিয়ে বলল, নিহন, তুমি আমার এই মাথা খারাপ মেয়েটাকে একটু দেখে রেখ।
নিহন মাথা নেড়ে বলল, আমি দেখে রাখব। তুমি চিন্তা কোরো না।
তোমার ওপর বিশ্বাস করে আমি যেতে দিচ্ছি। অন্য কেউ হলে আমি তার সাথে আমার এই পাগলী মেয়েকে যেতে দিতাম না। আমি জানি, তুমি নাইনাকে দেখে রাখবে।
.
খুব ভোরবেলা রওনা দিয়ে নিহন আর নাইনা দুপুরবেলার দিকে একটু বিশ্রাম নেওয়ার জন্য থামল। ডলফিন দুটো ক্ষুধার্ত, তাদের ছেড়ে দিয়ে দুজনে পানিতে শুয়ে থাকে। জলমানব শিশুদের জন্ম হয় পানিতে, তারা হাঁটতে শেখার আগে পানিতে ভেসে থাকতে শেখে। নিহন সমুদ্রের প্রায় উষ্ণ পানিতে নিশ্চল হয়ে শুয়ে নাইনাকে ডাকল, নাইনা।
বল।
ক্লান্ত হয়ে গেছ?
নাইনা ডলফিনের পিঠে বসে সমুদ্রের পানির ভেতর দিয়ে এত দূর এসে সত্যিই একটু ক্লান্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু সে এটি স্বীকার করতে চাইল না। বলল, না নিহন। ক্লান্ত হই নি!