মাজুর তার উত্তেজক পানীয়ের গ্লাসে একটা চুমুক দিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ কাটুস্কা?
কাটুস্কা গম্ভীর মুখে বলল, আমি বলতে চাইছি যে আমাদের জীবনে কোনো আনন্দ নেই। আমাদের জীবনের কোনো অর্থও নেই। আমরা ভান করি আমাদের জীবন খুব গুরুত্বপূর্ণ, আমাদের অনেক আনন্দ-আসলে এসব বাজে কথা। আনন্দ পাওয়ার জন্য সাইকাডোমে আমাদের মস্তিষ্কের মধ্যে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক রেডিয়েশন দিয়ে রেজোনেন্স করাতে হয়।
মাজুর মুখ শক্ত করে বলল, তুমি কী বলছ এসব? আমাদের জীবনে আনন্দ নেই? আমাদের জীবনের কোনো অর্থ নেই?
কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, না, নেই। আমাদের যা কিছু প্রয়োজন তার জন্য আমরা কোয়াকম্পের কাছে যাই। কোয়াকম্প হচ্ছে কোয়ান্টাম কম্পিউটার, সে আমাদের সবকিছুর সমাধান করে দেয়।
তা-ই তো দেবার কথা। দ্রীমান অধৈর্য হয়ে বলল, সেজন্যই তো কোয়াকম্প তৈরি করা হয়েছে।
কাটুস্কা জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল, কোয়াকম্পের একটা বোতাম টিপে একটা তথ্য বের করে আমি তোমাদের মতো আনন্দে লাফাতে পারি না।
মাজুর মুখ শক্ত করে বলল, তুমি তা হলে কী চাও?
কাটুস্কা বলল, আমি জানি না।
ক্ৰানা হতাশার ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, কাটুস্কা, তোমার কিসের অভাব? তোমার বাবা প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান। তোমার চেহারা অপূর্ব। তোমার জিনেটিক কোডিং একেবারে সবার ওপরে। তোমার আইকিউ অসাধারণ। তুমি সর্বশ্রেষ্ঠ ইনস্টিটিউটে পড়াশোনা করছ। তোমার এত কিছু থাকার পরও একেবারে সাধারণ রাস্তার একটা হতভাগা ছেলের মতো কথা বলছ কেন?
কাটুস্কা বিষণ্ণ গলায় বলল, আমি জানি না।
মাজুর একটু এগিয়ে এসে কাটুস্কার পিঠে থাবা দিয়ে বলল, কাটুস্কা, মন ভালো কর। এ রকম গোমড়ামুখে থেকো না। তোমার এখন কী প্রয়োজন জান?
কী?
মাজুর গলায় একটু নাটকীয় ভাব এনে বলল, তোমার জীবনে এখন প্রয়োজন খানিকটা উত্তেজনা।
উত্তেজনা?
হ্যাঁ, তোমার জীবন একটু একঘেয়ে হয়ে গেছে।
ক্ৰানা জিজ্ঞেস করল, সেই উত্তেজনাটুকু আসবে কীভাবে?
মাজুর চোখ বড় বড় করে বলল, খুব সহজে। আমরা কাটুস্কাকে নিয়ে যাব জলমানব শিকারে।
কাটুস্কা ভুরু কুঁচকে মাজুরের দিকে তাকিয়ে রইল। মাজুর বলল, মানুষের জীবনে এর চাইতে বড় উত্তেজনার কিছু নেই। যারা গিয়েছে তারা বলেছে এই অভিজ্ঞতার কোনো তুলনা নেই। একজন ভিতু মানুষ, দুর্বল মানুষ, আত্মবিশ্বাসহীন মানুষ জলমানব শিকার করার পর সম্পূর্ণ অন্য মানুষ হয়ে যায়। তার কোনো দুর্বলতা থাকে না। ভয়-ভীতি থাকে না। রাতারাতি জীবনটা অন্য রকম হয়ে যায়।
কাটুস্কা জিজ্ঞেস করল, সত্যি?
হ্যাঁ, সত্যি।
কেন?
মনোবিজ্ঞানীরা বলতে পারবেন। জলমানবেরা মানুষের মতো কিন্তু মানুষ নয়, তাই। তাদের হত্যা করায় উত্তেজনা আছে, অপরাধবোধ নেই-এ রকম একটা ব্যাখ্যা পড়েছিলাম।
কাটুস্কা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, খুব বিচিত্র ব্যাখ্যা।
বিচিত্র হতে পারে, কিন্তু সত্যি। মাজুর কাটুস্কার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি যেতে চাও?
কাটুস্কা মাথা নাড়ল, বলল, দেখি চেষ্টা করে।
দশ হাজার ইউনিট লাগবে।
সেটা হয়তো সমস্যা নয়। আমার বাবা আমাকে দশ হাজার ইউনিট দিতে রাজি হয়েছেন।
মাজুর মাথা ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, চমৎকার।
দ্রীমান বলল, আমিও যাব।
মাজুর খুশি হয়ে বলল, তা হলে তো আরো ভালো। ক্রানা, তুমি যাবে না?
বলল, তোমরা সবাই যদি যাও তা হলে আমি একা পড়ে থাকব কেন?
চমৎকার। আনন্দে মাজুর তার উত্তেজক পানীয়টুকু এক ঢোকে শেষ করে বলল, তা হলে আমি ব্যবস্থা করে ফেলছি! ঠিক আছে?
সবই মাথা নাড়ল। বলল, ঠিকু আছে।
.
মাজুর খুব কাজের ছেলে, এক সপ্তাহের ভেতর সে সব ব্যবস্থা শেষ করে ফেলল। নানা রকম নৌযানে যাওয়া যায়, তারা বেছে নিল সাধারণ একটা ইয়ট। সমুদ্রের নীল পানিতে ধবধবে সাদা একটা ইয়ট ভেসে যাচ্ছে বিষয়টা চিন্তা করেই সবার মন ভালো হয়ে যেতে শুরু করে। ইয়টে থাকা-খাওয়া-বিনোদন-সবকিছুর ব্যবস্থা রয়েছে, জুরা অভিজ্ঞ, তারা পুরো শিকারের বিষয়টা যেন নিরাপদে শেষ করা যায় তার ঘুঁটিনাটি ব্যবস্থা করে রাখল।
প্রথম দিনেই তাদের স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ব্যবহার করা শেখানো হল। নূতন ব্রনের অস্ত্র, একটা ম্যাগাজিনে প্রায় এক শ বুলেট থাকে। ট্রিগার টেনে ধরে রাখলে মুহূর্তে ম্যাগাজিন খালি হয়ে যায়। ইয়টের ডেকে দাঁড়িয়ে চলন্ত টার্গেটের মধ্যে গুলি করতে করতে কাটুস্কা বিচিত্র এক ধরনের উত্তেজনা অনুভব করে। স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রটায় হাত বুলিয়ে সে মাজুরকে বলল, অস্ত্র কী বিচিত্র একটা জিনিস দেখেছ?
মাজুর দূরে ভাসমান একটা টার্গেটে এক পশলা গুলি ছুঁড়ে দিয়ে বলল, কেন? তোমার কাছে এটা বিচিত্র কেন মনে হচ্ছে?
এটা তৈরিই করা হয়েছে মানুষকে হত্যা করার জন্য। মানুষ হয়ে মানুষকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তৈরি করা যায়, বিষয়টা কেমন জানি অদ্ভুত মনে হয়।
দ্রীমান বলল, শুধু মানুষকে হত্যা করার জন্য অস্ত্র তৈরি হয় নি। অন্য অনেক জন্তু জানোয়ার অস্ত্র দিয়ে হত্যা করা হয়। জলমানবকে হত্যা করা হয়।
কাটুস্কা মাথা নাড়ল, আস্তে আস্তে বলল, অস্ত্র আসলেই খুব বিচিত্র একটা জিনিস। আমি কখনো ভাবি নি আমি কোনো জীবন্ত প্রাণীকে হত্যা করতে পারব। কিন্তু এটা হাতে নেওয়ার পরই আমার কেমন জানি হাত নিশপিশ করছে। কোনো একটা জীবন্ত প্রাণীকে গুলি করব, সেটা ছটফট করতে থাকবে সেই দৃশ্যটা দেখার জন্য ভেতরটা কেমন জানি আকুলি বিকুলি করছে।