নিহন নিচের চেম্বারগুলো পরীক্ষা করে ওপরে উঠে এলে কায়ীরা জানতে চাইল, নিচে কীরকম অবস্থা, নিহন?
আট-দশ ঘণ্টা থাকার জন্য ঠিক আছে, কিন্তু তার বেশি হলে সমস্যা!
তার বেশি হওয়ার কথা নয়!
তা হলে ঠিক আছে।
কী করছে সবাই?
ছোটরা হাঙর হাঙর খেলছে। তাদের মনে হয় খুব আনন্দ হচ্ছে।
আর বড়রা?
তারা বসে বসে গল্প-গুজব করছে। কেউ কেউ তাস খেলছে।
চমৎকার।
যারা ছোটও না বড়ও না তারা দেখে এসেছি গান গাইছে।
কায়ীরা মুখের ওপর থেকে মুখের পানি মুছে ফেলে হেসে ফেলল, চমৎকার। চল, আমরাও গিয়ে গানের আসরে যোগ দিই।
হ্যাঁ, চল। নিচে সবাই তোমার জন্য অপেক্ষা করছে।
দাঁড়াও তার আগে রিসি বুড়োকে নিচে পাঠিয়ে দিই! সে কিছুতেই আগে যেতে রাজি হল না!
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ, সবাই জানে টাইফুন এলেই রিসি বুড়োর অন্য রকম আনন্দ হয়।
নিহন কায়ীরার পিছু পিছু এগিয়ে যায়। পাটাতনের মাঝামাঝি জায়গায় অতিকায় সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলর মাঝখানে রিসি বুড়ো দুই হাত বুকের কাছে রেখে নিশ্চল হয়ে শুয়ে আছে। বৃষ্টির পানিতে সে ভেসে যাচ্ছে, কিন্তু সেটা নিয়ে এতটুকু বিকার নেই। সে পানিকে খুব ভালবাসে। কায়ীরা উবু হয়ে কাছে বসে ডাকল, রিসি বুড়ো।
রিসি বুড়ো চোখ খুলে তাকাল, বলল, কী হয়েছে, কায়ীরা?
টাইফুনটা প্রায় চলে এসেছে। এখন চল নিচে যাই।
তোমরা যাও, কায়ীরা।
কায়ীরা অবাক হয়ে বলল, আমরা যাব? আর তুমি?
আজকে তোমার হাতে সকল দায়িত্ব তুলে দেওয়ার পর নিজেকে খুব হালকা মনে হচ্ছে। আমার আর কোনো দায়িত্ব নেই।
হ্যাঁ, কিন্তু
আমি সারা জীবন যেটা করতে চেয়েছিলাম আজকে সেটা করব, কায়ীরা।
কী করবে, রিসি বুড়ো?
আমার এই সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলে শুয়ে শুয়ে টাইফুনকে খুব কাছ থেকে দেখব।
কায়ীরা চমকে উঠে বলল, কী বলছ তুমি?
হ্যাঁ, কায়ীরা, আমি ঠিকই বলছি। আমাকে তোমরা সমুদ্রের পানিতে ভাসিয়ে দাও। আমি সমুদ্রের পানিতে ভেসে ভেসে টাইফুনকে দেখতে চাই
তুমি কী বলছ? একটু পরে যখন বড় বড় ঢেউ আসবে তুমি কোথায় তলিয়ে যাবে
আমি জানি। রিসি বুড়ো তার শীর্ণ মুখে হাসে, হাসতে হাসতে বলে, আমি সারা জীবন এ রকম একটি কথা চিন্তা করেছি। টাইফুনের বাতাস আর সমুদ্রের ঢেউ, আমি তার মাঝে ধীরে ধীরে তলিয়ে যাচ্ছি! কী চমৎকার একটি জীবন!
কায়ীরা নিঃশব্দে কিছুক্ষণ রিসি বুড়োর দিকে তাকিয়ে রইল। তারপর একটা বড় নিঃশ্বাস ফেলে ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করল, তুমি সত্যিই এটা চাও, রিসি বুড়ো?
হ্যাঁ, কায়ীরা। আমি সত্যিই এটা চাই। আমি সারা জীবন এ রকম একটা সময়ের জন্য অপেক্ষা করছিলাম।
কায়ীরা কোনো কথা না বলে রিসি বুড়োর শীর্ণ হাতটি নিজের হাতে টেনে নেয়। রিসি বুড়ো ফিসফিস করে বলল, আমার কী ভালো লাগছে তুমি চিন্তা করতে পারবে না। তোমার মতো একজনের হাতে সবার দায়িত্ব দিয়ে কী নিশ্চিন্ত হয়ে বিদায় নিতে পারছি। একজন মানুষ তার জীবনে আর কী চাইতে পারে? রিসি বুড়ো শীর্ণ হাতে কায়ীরার মুখ স্পর্শ করে বলল, আমাকে বিদায় দাও, কায়ীরা।
অতিকায় সামুদ্রিক কচ্ছপের খোলটি পানিতে ভাসিয়ে দেওয়া হল। সমুদ্রের উত্তাল ঢেউয়ে দুলতে দুলতে সেটি ধীরে ধীরে ভেসে যেতে থাকে।
কায়ীরার পাশে নিহন চুপ করে দাঁড়িয়ে থেকে সেদিকে তাকিয়ে থাকে। প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়ায় তাদেরকে মনে হয় উড়িয়ে নেবে, তবুও তারা সামুদ্রিক কচ্ছপের বিশাল খোলটি বহু দূরে অদৃশ্য না হয়ে যাওয়া পর্যন্ত নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে রইল।
০৪. প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন
প্রতিরক্ষা দপ্তরের প্রধান রিওন শুতে গিয়ে আবিষ্কার করল তার আঠার বছরের মেয়ে কাটুস্কার ঘরে এখনো আলো জ্বলছে। এত রাত পর্যন্ত জেগে জেগে কাটুস্কা কী করছে দেখার জন্য রিওন তার মেয়ের ঘরের দরজা খুলে ভেতরে উঁকি দিল। কাটুস্কা বিছানায় হাঁটু মুড়ে বসে মনিটরের দিকে তাকিয়ে আছে। রিওন একটু অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল, এত রাতে তুমি কী করছ কাটুস্কা?
দেখছি।
কী দেখছ?
টাইফুন। উপগ্রহের ছবিতেই এটা ভয়ঙ্কর। সত্যি সত্যি যদি দেখা যেত তা হলে না জানি কত ভয়ঙ্কর দেখাত।
রিওন হেসে বলল, তোমার কী হয়েছে কাটুস্কা, তুমি এত রাত জেগে মনিটরে উপগ্রহের তোলা টাইফুনের ছবি দেখছ কেন?
ইনস্টিটিউট থেকে আমাদের হোমওয়ার্ক দিয়েছে। কোয়াকম্প ব্যবহার করে এর গতিপথটা বের করতে হবে। তারপর দেখতে হবে আমাদের হিসাবের সঙ্গে মেলে কি না।
কী দেখলে? মিলেছে?
কাটুস্কা মাথা নাড়ল। বলল, হ্যাঁ বাবা, মোটামুটি মিলে গেছে। টাইফুনটা যেদিক দিয়ে যাওয়ার কথা ঠিক সেদিক দিয়েই যাচ্ছে।
চমকার। এখন তা হলে ঘুমাও।
হ্যাঁ বাবা, ঘুমাব।
রিওন চলে যাচ্ছিল, কাটুস্কা তাকে থামাল, বলল, বাবা।
কী কাটুস্কা?
উপগ্রহের ছবিতে দেখেছিলাম সমুদ্রের ওপর ছোট ঘোট দ্বীপ। এগুলো কি জলমানবদের আস্তানা?
সম্ভবত।
ঠিক ওদের আস্তানার ওপর দিয়ে টাইফুনটা যাচ্ছে। জলমানবদের কী হবে, বাবা?
কী আর হবে? শেষ হয়ে যাবে।
তারা সরে যায় না কেন?
কেমন করে সরে যাবে? টাইফুন আসার ভবিষ্যদ্বাণীটাও তো তারা করতে পারে না। ওদের কাছে তো কোনো যন্ত্রপাতি নেই। রিওন মাথা নেড়ে বলল, কাটুস্কা তোমার হয়েছেটা কী? কদিন থেকে শুধু জলমানব, জলমানব করছ।