নিহন কায়ীরাকে খুঁজে বের করে, সে ডুবিয়ে রাখা অংশটুকুতে বাতাসের চাপ পরীক্ষা করছিল। নিহন কাছে দাঁড়িয়ে ধৈর্য ধরে অপেক্ষা করে, যখন সে একটু সময় পেল নিহন জিজ্ঞেস করল, কায়ীরা, তুমি কি আমাকে নূতন কিছু করতে দেবে, নাকি আমি নিজে কিছু একটা বের করে নেব?
আমি দিচ্ছি নিহন। তুমি একটু অপেক্ষা কর।
ঠিক আছে।
যারা সমুদ্রে গিয়েছিল, সবাইকে কি খবর দেওয়া হয়েছে?
হ্যাঁ, খবর দেওয়া হয়েছে। তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে।
কায়ীরা আকাশের দিকে তাকাল, বলল, মাঝরাত থেকেই টাইফুনের ঝাপটা টের পেতে থাকব। শেষ রাতে সেটা বিপজ্জনক হয়ে যাবে। আমাদের হাতে সময় খুব কম।
নিহন কোনো কথা বলল না। কায়ীরা অনেকটা আপনমনে বলল, তার আগেই আমাদের সব কাজ শেষ করতে হবে।
মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ একটা মোটা দড়ি টেনে আনতে আনতে বলল, তুমি চিন্তা কোরো না, কায়ীরা। তার আগেই আমাদের সব কাজ শেষ হয়ে যাবে।
কায়ীরা মুখে হাসি টেনে এনে বলল, আমি সেটা জানি। তোমরা সব কাজ শেষ করে ফেলবে সেটা আমি জানি।
কায়ীরা ঘুঁটিনাটি কয়েকটা জিনিস দেখে উঠে দাঁড়িয়ে নিহনকে বলল, তোমার দশজন ঠিক আছে?
নয়জন। ক্রিকে পানির পাম্পের কাজে লাগিয়ে দিয়েছে। কায়ীরা এক মুহূর্তের জন্য ভুরু কুঁচকে বলল, তার মানে তুমি একা গিয়েছিলে?
হ্যাঁ।
কায়ীরা কয়েক মুহূর্ত নিহনের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে একটা ছোট নিঃশ্বাস ফেলে বলল, বেঁচে থাকতে হলে ঝুঁকি নিতে হয়। কিন্তু কতটুকু ঝুঁকি নেওয়া যায় সেটা কিন্তু তোমাকে চিন্তা-ভাবনা করে ঠিক করতে হবে।
আমি করি, কায়ীরা।
মনে রেখ সাহস আর বোকামির মাঝে পার্থক্যটা খুব অস্পষ্ট।
মনে রাখব, তুমি চিন্তা কোরো না।
ঠিক আছে। আমরা আমাদের পুরো দ্বীপটাকে ভাগ ভাগ করে ডুবিয়ে দিচ্ছি। এর নিচে বাতাস আটকে রাখার চেম্বারগুলো আছে। আমরা সবাই সেখানে থাকব।
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। জানি।
এত মানুষের অক্সিজেন সাপ্লাই সোজা কথা নয়। ওপর থেকে পাম্প করে আনতে হবে। চেম্বারগুলো পুরোপুরি বায়ুনিরোধক কি না দেখতে হবে। তুমি তোমার নয়জন নিয়ে সেগুলো পরীক্ষা কর। চেম্বারগুলো পুরোনো, অনেক জায়গায় জং ধরে গেছে। ছোটখাটো ফুটো অনেক আছে, বিপজ্জনক বড় ফুটো থাকলে সেগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা কর।
নিহন বলল, ঠিক আছে, কায়ীরা।
মনে রেখ, যখন সবাই চেম্বারে বসে থাকবে তখন কিছু একটা ঘটে গেলে কিন্তু কিছু করতে পারবে না। যা করার আগে থেকে করতে হবে।
বুঝতে পেরেছি, কায়ীরা।
যাও, নিচে চলে যাও।
.
নিহন তার দলের নয়জনকে তাদের দায়িত্ব বুঝিয়ে দিল। পানির নিচে কাজ করার জন্য তারা নিজেদের অক্সিজেন মাস্কগুলো লাগিয়ে নেয়। বাতাসে দ্রবীভূত অক্সিজেনকে বের করে নেওয়ার এই যন্ত্রটি অত্যন্ত চমকপ্রদ। জলমানবেরা দীর্ঘদিন পরিশ্রম করে এটাকে ধীরে ধীরে প্রস্তুত করেছে। নিচে অন্ধকার, দেখার জন্য তারা সবাই আলোর টিউব নিয়ে নেয়। কিছু ব্যাক্টেরিয়া থেকে আলো বের হয়, সেগুলো সগ্রহ করে এই টিউব তৈরি করা হয়েছে। ব্যাক্টেরিয়াগুলোকে বাঁচিয়ে রাখতে পারলেই দীর্ঘদিন আলো পাওয়া যায়-তীব্র আলো নয়, কিন্তু কাজ চলে যায়।
পানির নিচে ঢুকে ওরা আলাদা হয়ে যায়, বাতাস আটকে রাখা চেম্বারগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে। জায়গায় জায়গায় পানির বুদ্বুদ বের হচ্ছে। একজন বাইরে থেকে ফুটোগুলো বের করে, আরেকজন ভেতরে ঢুকে ছোট ছোট ফুটো বুজিয়ে দিতে রু করে। আঠালো এক ধরনের পেস্ট নিয়ে এসেছে, গর্তের ওপর লাগানো হলে বাতাসের চাপে গর্তের ভেতরটুকু সঙ্গে সঙ্গে বুজিয়ে দেয়।
চেম্বারগুলো বায়ু নিরোধক করে ওরা যখন ওপরে উঠে এসেছে তখন অনেক রাত। ওপরে গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টি, তার সঙ্গে দমকা হাওয়া বইছে। ভাসমান দ্বীপের বেশিরভাগই ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে সব মানুষ ছোট একটা জায়গায় ভিড় করে রয়েছে। অনেকেই নৌকার মধ্যে আশ্রয় নিয়েছে, বাতাসে নৌকাগুলো দুলছে, সবাই সমুদ্রের নিচে চলে যাওয়ার পর। নৌকাগুলোও ডুবিয়ে দেওয়া হবে। আজ রাতের জন্য সবার খাবারের আয়োজন করা হয়েছে এক জায়গায়, আগে কমবয়সীদের খাইয়ে দিয়ে বড়রা দ্রুত খেয়ে নিচ্ছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষগুলো পানির নিচে চলে যেতে রু করবে।
নিহন তার খাবারটুকু নিয়ে একটা নৌকার পাটাতনে বসে দ্রুত খেয়ে নেয়। প্লেটটা বৃষ্টির পানিতে ধুয়ে সে নির্দিষ্ট জায়গায় রেখে দিয়ে কায়ীরাকে খুঁজে বের করল। কায়ীরা ছোট ছোট দলে ভাগ করে দিয়ে সবাইকে পানির নিচে পাঠাতে শুরু করেছে। টাইফুনটি তাদের ওপর দিয়ে চলে যেতে কত সময় নেবে কে জানে, এই পুরো সময়টুকু পানির নিচে থাকতে হবে। টাইফুন চলে যাওয়ার পর আবার সবকিছু পানির ওপর ভাসিয়ে এনে তাদের জীবন শুরু করতে হবে।
নিহনকে দেখে কায়ীরা বলল, চেম্বারগুলো ঠিক আছে?
হ্যাঁ, কায়ীরা। ফুটোগুলো বন্ধ করেছি। অক্সিজেনের সাপ্লাই ঠিক রাখলে কোনো সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
চমৎকার। তুমি তা হলে আমাদের সঙ্গে হাত লাগাও, সবাইকে পানির নিচে পাঠাতে শুরু কর।
ঠিক আছে, কায়ীরা।
.
প্রায় হাজার দুয়েক মানুষকে পানির নিচে চেম্বারগুলোতে নামিয়ে দিতে দিতে রাত আরো গম্ভীর হয়ে যায়। খানিকক্ষণ আগে যেটা ছিল দমকা বাতাস এখন সেটা রীতিমতো ঝড়ো হাওয়া। গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও এখন প্রবল বৃষ্টিতে পাল্টে গেছে। বৃষ্টির ঠাণ্ডা পানিতে সবাই শীতে অল্প অল্প কাঁপছে। নৌকাগুলো পানিতে ডুবিয়ে দেওয়া হয়েছে। শুধু বহুষ্কোণ একটা ভাসমান পাটাতন সমুদ্রের পানিতে দুলছে। সেখানে কায়ীরা কয়েকজনকে নিয়ে অপেক্ষা করছে।