- বইয়ের নামঃ জলমানব
- লেখকের নামঃ মুহম্মদ জাফর ইকবাল
- প্রকাশনাঃ সময় প্রকাশন
- বিভাগসমূহঃ বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনী
০১. কায়ীরা কোমরে হাত দিয়ে
জলমানব
কায়ীরা কোমরে হাত দিয়ে খানিকটা অনিশ্চিত ভঙ্গিতে ভাসমান দ্বীপটির কিনারায় নিঃশব্দে দাঁড়িয়ে ছিল। সমুদ্রের ছোট ছোট ঢেউ মৃদু শব্দ করে ভাসমান দ্বীপের পাটাতনে আছড়ে পড়ছে, কায়ীরার দৃষ্টি এই সবকিছু ছাড়িয়ে বহু দূরে কোথাও আটকে আছে। তাকে দেখে মনে হয় না সে নির্দিষ্ট করে কিছু দেখছে কারণ দেখার কিছু নেই, চারদিকে যতদূর চোখ যায় শুধু সমুদ্রের নীল পানি, এর মাঝে কোনো ব্যতিক্রম নেই, বৈচিত্র্য নেই, তাই কাউকে নির্দিষ্ট একটা ভঙ্গিতে একদিকে তাকিয়ে দেখতে থাকলে এক ধরনের অস্বস্তি হয়।
নিহনেরও একটু অস্বস্তি হচ্ছিল, সে সমুদ্রের পানি থেকে নিজের পা দুটি ওপরে তুলে নিচু গলায় ডাকল, কায়ীরা।
কায়ীরা ঠিক শুনতে পেল বলে মনে হল না। নিহন তখন গলা আরেকটু উঁচিয়ে ডাকল, কায়ীরা।
কায়ীরা বলল, শুনছি। বল।
তুমি কী দেখছ?
কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, জানি না
তা হলে এভাবে দূরে তাকিয়ে আছ কেন?
কায়ীরা ঘুরে নিহনের দিকে তাকিয়ে একটু হাসার ভঙ্গি করল। কায়ীরার বয়স চল্লিশের কাছাকাছি, যখন তার বয়স কম ছিল তখন সে নিশ্চয়ই অপূর্ব সুন্দরী একটা মেয়ে ছিল। এই জীবনটিতে তার ওপর দিয়ে অনেক ঝড়-ঝাপটা গিয়েছে, সেই ঝড়-ঝাপটা ভরা কঠিন একটি জীবন, দুঃখ-কষ্ট আর সমুদ্রের লোনা পানিতে তার সৌন্দর্যের কমনীয়তাটুকু চলে গিয়ে সেখানে এক ধরনের বিষাদ পাকাপাকিভাবে স্থান করে নিয়েছে। কায়ীরার মাথায় কাঁচাপাকা চুল, তার তামাটে রোদেপোড়া গায়ের রঙ এবং সুগঠিত শরীর। মাথার চুল পেছনে শক্ত করে বাধা, পরনে সামুদ্রিক শ্যাওলার একটা সাদামাটা পোশাক, গলায় হাঙরের দাঁত দিয়ে তৈরি একটা মালা। এই অতি সাধারণ পোশাকেও কায়ীরাকে কেমন জানি অসাধারণ দেখায়।
কায়ীরা একটা নিঃশ্বাস ফেলে বলল, আমার মনে হয় একটা টাইফুন আসছে।
নিহন চমকে উঠে কায়ীরার দিকে তাকাল, বলল, কী বলছ তুমি?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। এখন টাইফুনের সময়। সমুদ্রের পানির তাপমাত্রা বাড়ছে-এটা বছরের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর সময়।
নিহন অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে একবার সমুদ্রের দিকে আরেকবার আকাশের দিকে তাকাল, তারপর শুকনো গলায় বলল, তুমি কেমন করে বুঝতে পারলে টাইফুন আসছে? কী দেখে বুঝতে পারলে?
কায়ীরা মাথা নাড়ল, বলল, জানি না। বাতাসে কিছু একটা হয়, পানিতে কিছু একটা আসে। কিছু একটা পরিবর্তন হয়।
আমি তো কিছু বুঝতে পারছি না।
তুমি যখন আমার মতো বুড়ি হবে তখন তুমিও বুঝতে পারবে।
নিহন বলল, তুমি মোটেও বুড়ি না। তুমি, তুমি নিহন বাক্যটা শেষ করতে পারল না।
কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমি কী?
তুমি এখনো অনেক সুন্দরী।
কায়ীরা শব্দ করে হেসে বলল, তোমার বয়স কত হল নিহন?
সতের।
সতের? আমার ছেলেটি বেঁচে থাকলে সে এখন তোমার বয়সী হত।
নিহন মাথা নাড়ল, বলল, হ্যাঁ। ভাসমান দ্বীপের সবাই জানে কায়ীরার পাঁচ বছরের দুরন্ত ছেলে আর দুঃসাহসী বাবা একটা খ্যাপা হ্যাঁমার হেড হাঙরের আক্রমণে মারা গেছে। কেউ সেটা নিয়ে কথা বলে না। কায়ীরা হাসিমুখে বলল, তোমার বয়স যখন সতের তখন তোমার কী করা উচিত জান?
কী?
তোমার বয়সী একটা সুন্দরী মেয়ে খুঁজে বের করা। আমাদের এই দ্বীপে অনেক আছে।
নিহন কেন জানি একটু অপ্রস্তুত হয়ে গেল, ইতস্তত করে বলল, আমি আসলে ঠিক এভাবে বলছিলাম না।
তা হলে কীভাবে বলছিলে?
শুধু চেহারা দিয়ে তো মানুষের সৌন্দর্য হয় না। সৌন্দর্যের জন্য আরো অনেক কিছু লাগে।
আর কী কী লাগে?
সাহস লাগে, বুদ্ধি লাগে, অভিজ্ঞতা লাগে। তা ছাড়া মানুষটাকে অনেক ভালো হতে হয়। যা যা দরকার তোমার ভেতরে তার সবকিছু আছে।
কায়ীরা কিছু না বলে খানিকটা কৌতুকের সঙ্গে এই কমবয়সী ছেলেটার দিকে তাকিয়ে রইল। ভাসমান দ্বীপের এই বয়সী ছেলেমেয়ে থেকে নিহন যে একটু আলাদা এটা সে আগেও লক্ষ করেছে। কায়ীরা জিজ্ঞেস করল, আমার সবকিছু আছে? সব?
না, ঠিক সবকিছু নেই-
কী কী নেই?
তোমার পরিবার নেই। তুমি একা থাক-কিন্তু সেটা তো তুমি ইচ্ছে করে কর। তুমি চাইলেই তোমার একটা পরিবার থাকত। আমাদের ভাসমান দ্বীপের সব ব্যাটাছেলে তোমাকে বিয়ে করার জন্য এক পায়ে দাঁড়িয়ে আছে-
কায়ীরা হাত নেড়ে বলল, থাক, অনেক হয়েছে। কোন কোন ব্যাটাছেলেরা আমার পেছনে ঘুরঘুর করে সেটা তোমার মুখ থেকে শুনতে হবে না। সেটা আমিই ভালো করে জানি। এখন এই ব্যাটাছেলেদের কাজে লাগাতে পারলে হয়
তুমি টাইফুনের কথা বলছ?
হ্যাঁ। কায়ীরা ঘুরে তাদের ভাসমান দ্বীপটার দিকে তাকাল, এটি প্রায় পাঁচ কিলোমিটার লম্বা আর দুই কিলোমিটার চওড়া। এখানে সব মিলিয়ে প্রায় দুই হাজার মানুষ থাকে। বড় ধরনের টাইফুন এলে সবাইকে পানির নিচে লম্বা সময়ের জন্য আশ্রয় নিতে হয়। সবকিছু নিয়ে লম্বা সময়ের জন্য পানির নিচে যাওয়া খুব সহজ ব্যাপার নয়।
কায়ীরা, তোমার কি সত্যিই মনে হচ্ছে টাইফুন আসবে? আকাশ ঝকঝকে পরিষ্কার
আর কয়েক ঘণ্টার মাঝে এটা ঝকঝকে পরিষ্কার থাকবে না। ব্যারোমিটারের পারদ নিচে ঝাঁপ দেবে