য়ুল অনুবাদক যন্ত্র চালু করে রেখেছে, যান্ত্রিক কণ্ঠে সেটি অনুবাদ করে দেয়, মেয়েটি জিজ্ঞেস করছে, তুমি কে? তোমার নাম কী?।
য়ুল বলল, তুমি আমাকে চিনবে না, আমি অনেক দূর থেকে এসেছি। আমার নাম য়ুল।
য়ুল! মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, কী বিচিত্র নাম!
তোমার নাম কী?
আমার নাম তিনা।
য়ুল মাথা ঝুঁকিয়ে বলল, তোমার সঙ্গে পরিচিত হয়ে আনন্দিত হলাম তিনা।
তুমি নিশ্চয়ই অনেক দূর থেকে এসেছ, কারণ তোমার কথা খুব বিচিত্র। কিন্তু তুমি কেমন করে অনেক দূর থেকে এসেছ? তুমি তো পানিতে নিশ্বাস নিতে পার না।
কে বলছে পারি না। এই যে দেখ আমি পারি।
মেয়েটি খিলখিল করে হেসে বলল, তুমি পার না, আমরা জানি।
কেমন করে জান?
আমরা দেখেছি। তুমি পানিতে নেমে নিশ্বাস নিতে পারছিলে না। তখন আমরা তোমার মুখে বাতাস ফুঁকে দিয়েছি। ছোট বাচ্চাদের যেরকম দিতে হয়!
মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হাসতে শুরু করে, যেন অত্যন্ত মজার কোনো ব্যাপার ঘটেছে। হাসি ব্যাপারটি সংক্রামক–য়ুলও হাসতে শুরু করে এবং প্রবাল পাহাড়ের আড়াল থেকে নানা বয়সী আরো কয়েকজন কিশোর–কিশোরী এবং তরুণী বের হয়ে আসে। তারা পানিতে ভাসতে ভাসতে য়ুলকে ঘিরে দাঁড়ায়।
একটি সাহসী কিশোর য়ুলের কাছাকাছি এসে দাঁড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি আগে পানির ভিতরে নিশ্বাস নিতে পার নি এখন কেমন করে পারছ?
য়ুল ঘুরে তার পিঠের সঙ্গে লাগানো অক্সিজেন সিলিন্ডারটি দেখাল, বলল, এই যে দেখছ–এখানে বাতাস ভরা আছে। এই বাতাস নল দিয়ে আমার নাকে যাচ্ছে, তাই আমি নিশ্বাস নিতে পারছি।
উপস্থিত সবার মাঝে একটা বিস্ময়ের ধ্বনি শোনা যায়। কিশোর ছেলেটি অবাক হয়ে বলল, এটা তুমি কেমন করে করেছ? বাতাস তো ধরে রাখা যায় না, বাতাস তো ভেসে ভেসে উঠে যায়।
দাঁড়িয়ে থাকা একটি মেয়ে জিজ্ঞেস করল, এত মসৃণ ঐ জিনিসটা তুমি কোথায় পেয়েছ? আমরা তো কখনো এত মসৃণ জিনিস দেখি নি?
য়ুল কী বলবে বুঝতে পারল না। তার সামনে যারা দাঁড়িয়ে আছে তারা মানুষের সভ্যতার কিছু জানে না। যন্ত্রপাতি দূরে থাকুক শরীরের পোশাক পর্যন্ত নেই, যেটুকু আছে সামুদ্রিক গাছের পাতা–লতা দিয়ে তৈরি। তাদের কাছে উচ্চচাপের অক্সিজেন সিলিন্ডার বা নিও পলিমারের পোশাক বা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের কোনো অর্থ নেই। তাদের কাছে জ্ঞান বা প্রযুক্তিরও কোনো অর্থ নেই। সৃষ্টির শুরুতে মানুষ যেভাবে নিজের শরীরের শক্তি আর মস্তিষ্কের বুদ্ধিমত্তা নিয়ে প্রকৃতির মুখোমুখি দাঁড়িয়েছিল, এখন আবার ঠিক সেই একই ব্যাপার। মানুষ আবার একেবারে সেই গোড়া থেকে শুরু করেছে। তাদের কৌতূহলী প্রশ্নের উত্তর সে কী করে দেবে?
মেয়েটি আরো একটু কাছে এগিয়ে এসে অক্সিজেনের সিলিন্ডারটি স্পর্শ করে বলল, কোথায় পেয়েছ তুমি এটা?
য়ুল একটু হাসার চেষ্টা করে বলল, পৃথিবীটা বিশাল বড়, তার মাঝে কত বিচিত্র জিনিস আছে তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।
সবাই মাথা নাড়ল। সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটি বলল, ঠিকই বলেছ তুমি, পৃথিবীটা অনেক বড়। কত কী আছে এখানে। কত রকম মাছ! কত রকম প্রাণী! কত রকম গাছ পাথর!
হ্যাঁ! সেগুলো যখন তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করবে, তখন দেখবে তার মাঝে কত কী শেখার আছে, জানার আছে। তুমি যত বেশি জানবে, দেখবে বেঁচে থাকা তত বেশি আনন্দের।
তিনা নামের মেয়েটি হঠাৎ খিলখিল করে হেসে উঠল, হাসতে হাসতে বলল, তোমার কথাগুলো কী অদ্ভুত। কী বিচিত্র! তুমি কোথায় এ রকম করে কথা বলতে শিখেছ?
য়ুল উত্তরে কী বলবে বুঝতে পারল না।
.
প্রবাল পাহাড়ের পাদদেশে দাঁড়িয়ে য়ুল এবং জল–মানব এবং জল–মানবীদের সঙ্গে একটি সখ্যতা গড়ে ওঠে। য়ুলকে তারা সমুদ্রের আরো গহিনে নিয়ে যায়। সমুদ্রগভীরের সুপ্ত আগ্নেয়গিরির উষ্ণ পাহাড়কে ঘিরে জল–মানবদের বসতি গড়ে উঠেছে। সেখানে মায়ের সাথে সাথে শিশুরা ভেসে বেড়াচ্ছে, জন্মের পরমুহূর্ত থেকে তারা স্বাধীন। খাবার জন্য সামুদ্রিক শ্যাওলা, জলজ উদ্ভিদ আর নানা ধরনের মাছ! ঘুমানোর জন্য পাথরের ওপর শ্যাওলার বিছানা। বসতির নেতৃত্ব দেবার জন্য একজন মানবী। সমুদ্রের বিপদ থেকে রক্ষা করার জন্য একদল সুদেহী প্রহরী, কিছু নারী কিছু পুরুষ। সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রয়োজনে ভিন্ন এক ধরনের সমাজ গড়ে উঠেছে।
য়ুল মুগ্ধ হয়ে তাদের মাঝে ঘুরে বেড়ায়, পানিতে ভেসে যেতে যেতে একসময় সে ভুলে যায় যে সে এসেছে গ্যালাক্সির অন্য প্রান্ত থেকে, সে তুলে যায় সে পৃথিবীর বাতাসে বেঁচে থাকা একজন মানুষ। যাদের সাথে সে ভেসে বেড়াচ্ছে তারা জলজ–মানব, পানিতে দ্রবীভূত অক্সিজেন আলাদা করে নেবার বিচিত্র দৈহিক ক্ষমতার অধিকারী।
য়ুল হঠাৎ করে বুঝতে পারে তারা আসলে কেই মানুষ, এই পৃথিবীর একই সন্তান।
০৭.
নিয়ন্ত্রণ প্যানেলের সামনে বসে কীশ মূল মহাকাশযানের সাথে যোগাযোগ করছে। য়ুলের সারা দিনের সংগ্রহ করা সব তথ্য এর মাঝে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে, ক্রন সেগুলো মহাকাশযানের মূল তথ্য কেন্দ্রে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছে। য়ুল তার ছোট বিছানায় পা তুলে বসে বসে জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে ছিল। মাথা ঘুরিয়ে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, কীশ।
বল।
আজকে আমার যেরকম অভিজ্ঞতা হয়েছে তার কোনো তুলনা নেই।