য়ুল হেঁটে হেঁটে নভোযানের জানালার কাছে দাঁড়ায়, বাইরে অন্ধকার নেমে এসেছে। আকাশে একটা অসম্পূর্ণ চাঁদ, চাঁদের হালকা জ্যোৎস্নায় বাইরে এক ধরনের অতিপ্রাকৃতিক পরিবেশের সৃষ্টি হয়েছে। সেদিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে য়ুল হঠাৎ করে নিজের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে। এই পৃথিবীতে সে একা নয়, এখানে মানুষ আছে।
য়ুল কীশের দিকে তাকাল, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি ওদের সাথে দেখা করতে যাব কীশ।
আমি জানতাম তুমি যেতে চাইবে।
তুমি ব্যবস্থা করে দিতে পারবে না?
কীশ নরম গলায় বলল, আমি চেষ্টা করে দেখতে পারি।
০৬.
সমুদ্রের নীল পানি থেকে কয়েক ফুট উঁচুতে ভাসমান যানটি স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। য়ুলের শরীরের সাথে লাগিয়ে রাখা অক্সিজেন সিলিন্ডারের চাপটুকু পরীক্ষা করে কীশ বলল, তোমার এই সিলিন্ডারে যে পরিমাণ অক্সিজেন আছে সেটা টেনেটুনে ছয় ঘণ্টা ব্যবহার করা যাবে। কাজেই তুমি এই সময়ের ভিতরে ফিরে আসবে।
য়ুল মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে।
সোজাসুজি উপরে ভেসে উঠো, আমি তোমাকে খুঁজে বের করব।
বেশ।
তোমার শরীরের ওপর যে পলিমারটুকু দেওয়া হয়েছে সেটা তাপ নিরোধক, তোমার ঠাণ্ডা লাগার কথা নয়। আস্তরণটুকু বেশ শক্ত–ছোটখাটো আঘাতে ছিঁড়ে যাবে না।
বেশ।
চোখের ওপর যে কন্টাক্ট লেন্স দেওয়া হয়েছে সেটি দিয়ে এখন তুমি পানির ভিতরে পরিষ্কার দেখতে পাবে। কোমরের ব্যাগে আলোর জন্য ফ্লেয়ার আছে। প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারবে। ওদের সঙ্গে কথা বলার জন্য অনুবাদক যন্ত্র থাকল, তুমি তো জান কীভাবে ব্যবহার করতে হয়।
জানি।
চমৎকার! পানিতে সাঁতার দেওয়ার জন্য, ওঠা–নামা করার জন্য ছোট জেট প্যাকটা থাকল। যোগাযোগ মডিউলটা তো আছেই, আমি তোমার সঙ্গে সারাক্ষণ যোগাযোগ রাখব। কোনো সমস্যা হলে বা বিপদ হলে আমাকে জানাবে।
জানাব।
আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার তোমার কোমরে একটা স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র ঝুলিয়ে দিয়েছি। ছয়টি ভিন্ন ভিন্ন মাত্রায় এটি কাজ করতে পারে। আঘাত দিয়ে অচেতন করে দেওয়া। থেকে শুরু করে একটা বিশাল পাহাড়কে চূর্ণ করে দিতে পারবে। আমি আশা করছি তোমার এটি ব্যবহার করতে হবে না, কিন্তু যদি ব্যবহার করতে হয় খুব সাবধান।
তুমি নিশ্চিন্ত থাক কীশ।
বেশ। এবারে তা হলে তুমি যেতে পার।
ধন্যবাদ কীশ। তোমাকে ধন্যবাদ।
ভাসমান যানটি পানির আরো কাছে নেমে আসে, য়ুল এক পাশে দাঁড়িয়ে খুব সাবধানে সমুদ্রের পানিতে নেমে পড়ে। এক মুহূর্তের জন্য শীতল পানিতে তার সারা দেহ কাঁটা দিয়ে ওঠে, কিছুক্ষণেই তার দেহের তাপমাত্রার সাথে সামঞ্জস্য রেখে পলিমারটুকু উষ্ণ হয়ে উঠবে। য়ুল চারপাশে তাকাল, আধো আলো আধো ছায়ার একটি অতিপ্রাকৃত পরিবেশ, তার মাঝে এক ধরনের অশরীরী সৌন্দর্য লুকিয়ে আছে।
য়ুল নিশ্বাস নিয়ে তার শ্বাসযন্ত্রটি পরীক্ষা করে দেখে, তারপর যোগাযোগ মডিউলটি স্পর্শ করে বলল, কীশ! সবকিছু ঠিক আছে।
চমৎকার!
তোমার সঙ্গে দেখা হবে কীশ, আমি যাচ্ছি।
মানুষের সঙ্গে তোমার পরিচয় আনন্দময় হোক।
য়ুল যোগাযোগ মডিউলটি বন্ধ করে সামনের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। ছোট জেট প্যাকটি থেকে পানির ধারা বের হয়ে এসে তাকে সামনে নিয়ে যাচ্ছে। য়ুল সংবেদনশীল যন্ত্রে পানির নিচে জলজ শব্দ শুনতে শুনতে সতর্ক চোখে চারপাশে তাকাতে তাকাতে এগিয়ে যেতে থাকে। এই বিশাল সমুদ্রে সে কাউকে খুঁজে পাবে না, তাকে অন্যেরা খুঁজে নেবে সেটাই সে আশা করে আছে।
সমুদ্রের নিচে থেকে প্রবালের পাহাড় উঁচু হয়ে উঠে এসেছে, সেখানে নানা ধরনের জলজ গাছ, তার ভিতরে রঙিন মাছ ছোটাছুটি করছে। উপরের পৃথিবী যেরকম প্রাণহীন, সমুদ্রের নিচে মোটেও সেরকম নয়। দেখে মনে হয় উপরের প্রাণহীন জগতের সব প্রাণী বুঝি এখানে এসে আশ্রয় নিয়েছে।
য়ুল প্রবাল পাহাড়ের পাদদেশে এসে থামে। তাকে দেখে কিছু রঙিন মাছ ছুটে পালিয়ে গেল, পায়ের কাছাকাছি একটা গর্ত থেকে ছোট একটা অক্টোপাস দ্রুত আড়ালে সরে গেল। য়ুল উপরের দিকে তাকাল, সূর্যের আলোতে সমুদ্রপৃষ্ঠ বিচিত্র এক ধরনের আলোতে ঝিকমিক করছে। য়ুল তার জেট প্যাক চালু করে আবার সামনে এগিয়ে যেতে শুরু করে হঠাৎ করে থেমে গেল, তার মনে হল সে যেন একটি নারীকণ্ঠ শুনতে পেয়েছে। য়ুল পানিতে আবার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে, চারদিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকাল, কোথাও কেউ নেই। য়ুল এই জলমানবীদের ভাষা এখনো জানে না, তাই মানুষের শাশ্বত কণ্ঠস্বরের ওপর নির্ভর করে সে বন্ধুত্বসূচক একটি শব্দ করল।
কাছাকাছি একটা পাথরের আড়াল থেকে বড় চোখের একটি মেয়ের মাথা উঁকি দেয়। য়ুল তার দিকে একটু এগিয়ে যেতেই মেয়েটি দ্রুত সরে গেল। য়ুল আবার তার আগের জায়গায় দাঁড়িয়ে গেল। কয়েক মুহূর্ত পর আবার সেই কৌতূহলী মুখটি প্রবালের পাথরের আড়াল থেকে উঁকি দেয়, অবাক বিস্ময়ে য়ুলের দিকে তাকিয়ে থাকে। য়ুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে থেকে হাত তুলে মেয়েটিকে ডাকল, মেয়েটি ভয় পেয়ে আবার আড়ালে সরে যায় এবং কিছুক্ষণ পর আবার ধীরে ধীরে কৌতূহলী চোখে বের হয়ে আসে। য়ুল মেয়েটির দিকে তাকিয়ে একটু হাসার চেষ্টা করল এবং মেয়েটি আবার একটু এগিয়ে আসে। মেয়েটির সুগঠিত নিরাভরণ দেহ কিছু জলজ পাতা শরীরে জড়িয়ে রেখেছে। মেয়েটি অনিশ্চিতের। মতো একটু এগিয়ে এসে দাঁড়িয়ে যায়। তারপর ভয় পাওয়া গলায় কিছু একটা বলল। সুরেলা কণ্ঠস্বরে সঙ্গীতের স্তবকের মতো কিছু কথা।