য়ুল একটু অপ্রস্তুত হয়ে বলল, সেটি সত্যি নয়। আমি মোটেই নিজেকে ধ্বংস করতে যাচ্ছিলাম না। আমি
তুমি যেখানে উপস্থিত হয়েছিলে এবং যেভাবে দুর্ঘটনা ঘটিয়েছ তার সঙ্গে আত্মহত্যার খুব বেশি পার্থক্য নেই।
সেটি সত্যি নয়। যেটা ঘটেছে সেটা একটা দুর্ঘটনা।
যে দুর্ঘটনা আহ্বান করে আনা হয় সেটি দুর্ঘটনা নয়, সেটি এক ধরনের নির্বুদ্ধিতা। আর যে নির্বুদ্ধিতার জন্য জীবন বিপন্ন হতে পারে সেটি আত্মহত্যা ছাড়া আর কিছু নয়।
য়ুল দুর্বলভাবে হাসার চেষ্টা করে বলল, কিন্তু তুমি অস্বীকার করতে পারবে না যে এটি একটি অসাধারণ অভিজ্ঞতা। আমি শুনেছিলাম মৃত্যুর পূর্বমুহূর্তে মানুষের চোখের সামনে তার পুরো স্মৃতি ভেসে যায়; কথাটি সত্যি আমি আমার শৈশবের অনেক দৃশ্য দেখেছি। যখন কিছুতেই নিশ্বাস নিতে পারছিলাম না, জীবনের সব আশা ছেড়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলছিলাম, তখন দেখলাম একটি নারীমূর্তি আমার কাছে এগিয়ে আসছে, এসে আমার ঠোঁটে ঠোঁট রেখে আমাকে চুমু খাচ্ছে! আমি ভেবেছিলাম সেটা নিশ্চয়ই মৃত্যুদূত!
কীশ কোনো কথা না বলে য়ুলের দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইল। য়ুল একটু অবাক হয়ে বলল, তুমি এভাবে আমার দিকে তাকিয়ে আছ কেন?
এমনি।
কী হয়েছে? আমি কি কিছু ভুল বলেছি?
যে নারীমূর্তি তোমাকে চুমু খেয়েছে তার চেহারা তোমার মনে আছে?
না, পুরো ব্যাপারটি ছিল এক ধরনের কাল্পনিক দৃশ্য, এক ধরনের হেলুসিনেশান। অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় যেরকম দৃষ্টিভ্রম হয় সেরকম। শুধু একটি জিনিস মনে আছে–আমার ঠোঁটে ঠোঁট রাখার সঙ্গে সঙ্গে মনে হল নিশ্বাস নিতে না পারার কষ্টটা কেটে গেল। সম্ভবত আমার মস্তিষ্ক তখন আমার শারীরিক যন্ত্রণার অনুভূতি কেটে দিয়েছিল। আমি শুনেছি মানুষ যখন অনেক কষ্ট পায় তখন কষ্টের অনুভূতি চলে যায়।
কীশ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে য়ুলের চোখের দিকে তাকিয়ে থেকে আস্তে আস্তে বলল, তুমি অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন মানুষ য়ুল। অত্যন্ত সৌভাগ্যবান একজন মানুষ। তুমি একেবারে নিশ্চিত মৃত্যুর হাত থেকে ফিরে এসেছ।
সেজন্য আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ কীশ। তুমি যদি ঠিক সময়ে গিয়ে আমাকে রক্ষা না করতে
আমি তোমাকে রক্ষা করি নি য়ুল।
য়ুল বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠে বলল, তুমি কী বলছ কীশ?
আমি তোমাকে রক্ষা করি নি।
তা হলে?
যোগাযোগ মডিউলে সঙ্কেত পেয়ে ছুটে গিয়ে দেখি তোমার অচেতন দেহ সমুদ্রের বালুবেলায় শুয়ে আছে।
য়ুল হতচকিতের মতো কীশের দিকে তাকিয়ে রইল। কীশ অন্যমনস্ক ভঙ্গিতে মাথা নেড়ে বলল, আমার পক্ষে তোমাকে রক্ষা করা সম্ভব ছিল না, কিছুতেই আমি সময়মতো তোমার কাছে যেতে পারতাম না।
তা হলে? য়ুল হতবাক হলে বলল, তা হলে আমাকে কে রক্ষা করেছে?
জ্ঞান হারানোর আগে তুমি যে নারীমূর্তিটি দেখেছিলে সেটি কোনো কাল্পনিক দৃশ্য ছিল না। সে মৃত্যুদূত ছিল না।
তা হলে?
সে তোমার ঠোঁটে ঠোঁট লাগিয়ে তোমার বুকের ভিতর অক্সিজেন দিয়ে তোমাকে বাঁচিয়ে রেখেছিল।
ব্যাপারটি বুঝতে ঝুলের কয়েক মুহূর্ত সময় লেগে যায়। যখন সে বুঝতে পারে তখন সে প্রায় লাফিয়ে উঠে দাঁড়ায়, কীশের কাঁধ ধরে বলল, তুমি কেমন করে জান?
তোমার শরীরে যোগাযোগ মডিউলে আমি দেখেছি। কীশ এক মুহূর্ত অপেক্ষা করে বলল, ইচ্ছে করলে তুমিও দেখতে পার। পুরো ঘটনাটুকু রেকর্ড করা আছে।
কোথায়? য়ুল প্রায় চিৎকার করে বলল, কোথায়?
এস আমার সঙ্গে।
কীশ নভোযানের যোগাযোগ কেন্দ্রে সুইচ স্পর্শ করতেই য়ুলের বুকে লাগানো যোগাযোগ মডিউলে রেকর্ড করা ছবিগুলো ভেসে আসে। প্রথম দিকের ঘটনাগুলো দ্রুত পার করে য়ুল সমুদ্রের পানিতে পড়ে যাওয়া থেকে দৃশ্যগুলো দেখতে শুরু করে। পানিতে তলিয়ে যাবার সঙ্গে সঙ্গে চারপাশে এক ধরনের আধো আলো আধো ছায়ার মতো পরিবেশ হয়ে যায়। য়ুলকে সরাসরি দেখা যাচ্ছিল না কিন্তু বাচার প্রাণান্তকর প্রচেষ্টায় সে হাত–পা ছুড়ছে সেটি স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছে। এক সময় সে হাঁপ ছেড়ে দিয়ে তলিয়ে যাচ্ছে–চারদিকে এক ধরনের অন্ধকার নেমে আসছে এবং হঠাৎ দূর থেকে কিছু মানবী মূর্তিকে দেখা গেল, নিরাভরণ দেহে তারা জলচর প্রাণীর আশ্চর্য সাবলীলতায় তার কাছে ছুটে আসে। তাকে ঘিরে কয়েকবার ঘুরে আসে, একজন সাবধানে তাকে ধরে উপরে তোলার চেষ্টা করে, বুকের মাঝে কান লাগিয়ে কিছু একটা শোনার চেষ্টা করে। নিজেদের মাঝে কিছু একটা নিয়ে বলাবলি করে তারপর একজন এগিয়ে এলে তার ঠোঁটে ঠোঁট স্পর্শ করে তার বুকের ভিতরে বাতাস ঠুকে দিতে শুরু করে। দেখতে দেখতে য়ুলের দেহে সজীবতা ফিরে আসে। নারীমূর্তিগুলো য়ুলকে ধরে পানির উপরে তুলে এনে সযত্নে বালুবেলায় শুইয়ে রেখে আসে।
য়ুল হতবাক হয়ে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে থাকে। একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, এরা কারা কীশ?
কীশ নরম গলায় বলল, মানুষ। পৃথিবীর মানুষ।
তারা কোথায় থাকে?
পানিতে?
পানিতেই?
হ্যাঁ। পৃথিবীর বাতাস বিষাক্ত হয়ে যাওয়ায় মানুষ পানিতে ফিরে গেছে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং করে সমুদ্রের পানি থেকে দ্রবীভূত অক্সিজেন নেওয়ার মতো ক্ষমতা করে দেওয়া হয়েছে। এরা এখন পানিতে বেঁচে থাকতে পারে।
তুমি কেমন করে জান?
আমি নিশ্চিতভাবে জানি না। আমি অনুমান করছি। ক্রিস্টাল ডিস্ক থেকে যেসব তথ্য পেয়েছি সেখানে এ ধরনের ব্যাপারে অভাস দেওয়া হয়েছিল। মানুষকে রক্ষা করার জন্য বড় ধরনের দৈহিক পরিবর্তন করে দেওয়া। আমি তখন বুঝতে পারি নি, এখন বুঝতে পারছি।