য়ুল সাবধানে আরো একটু সামনে এগিয়ে যায়, নিচে শান্ত গভীর নীল পানি, উপরে মেঘহীন নীল আকাশ। সমুদ্রের বাতাস বইছে, বাতাসে এক ধরনের নোনা গন্ধ। য়ুল হঠাৎ আবার চমকে ওঠে, হঠাৎ করে আবার তার মনে হয় কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে। চারদিকে তাকাল, কোথাও কেউ নেই, তা হলে কেন তার মনে হচ্ছে কেউ তার দিকে তাকিয়ে আছে?
য়ুল হঠাৎ নিজের ভিতরে এক ধরনের ভীতি অনুভব করে, কোনো কিছু না জানার ভীতি, না বোঝার ভীতি। সে একটু পিছনে সরে এসে বড় একটা পাথরে হেলান দিয়ে বসতে চাইল, এক পা পিছিয়ে আসতেই হঠাৎ করে ছোট একটা নুড়ি পাথরে তার পা হড়কে যায়। য়ুল তাল সামলে কোনোমতে দাঁড়িয়ে গেল, কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে দ্বিতীয়বার তার পা হড়কে যায় এবং কিছু বোঝার আগেই সে পাথরের গা ঘেঁষে গভীর সমুদ্রের পানিতে গিয়ে পড়ল। ঘটনার আকস্মিকতায় সে এত অবাক হয়েছিল যে তার মাঝে আতঙ্ক বা ভীতি পর্যন্ত জন্মাবার সময় হয় নি।
পানিতে ডুবে যেতে যেতে য়ুল হঠাৎ করে বুঝতে পারল মানুষের দেহ আসলে পানিতে ভেসে থাকতে পারে না। ভেসে থাকতে হলে সাঁতার নামক একটি অত্যন্ত প্রাচীন শারীরিক প্রক্রিয়া অনেক কৌশলে আয়ত্ত করতে হয়। ক্রসিয়াস গহপুঞ্জে পানির পরিমাণ এত কম যে সাঁতার শেখা দূরে থাকুক, সেখানে কোনো মানব সন্তানই কখনো পানিতে নিজের পুরো দেহকে ডোবাতে পারে নি।
পানিতে ডুবে গেলেও য়ুল খুব বেশি আতঙ্কিত হল না কারণ তার মনে আছে নিশ্বাস নেবার জন্য দুটি সূক্ষ্ম তন্তু তার নাকে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহিত করছে। য়ুলের বুকের কাছাকাছি যোগাযোগ মডিউলটি এতক্ষণে নিশ্চয়ই কীশের কাছে তথ্য পৌঁছে দিয়েছে এবং কীশ তাকে উদ্ধার করার জন্য একটা ব্যবস্থা করবেই।
সমুদ্রের শীতল পানিতে য়ুলের শরীর কাঁটা দিয়ে ওঠে, চোখের সামনে পানি এবং সেই পানির নিচের জগতটি একটি অবাস্তব জগতের মতো মনে হয়। য়ুল হাত নেড়ে কোনোভাবে ভেসে ওঠার চেষ্টা করতে করতে একবার নিশ্বাস নিতে চেষ্টা করে এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করে সে নিশ্বাস নিতে পারছে না। যে তন্তুটি তার নাকে বিশুদ্ধ বাতাস প্রবাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করছিল পানির নিচে সেটি কাজ করছে না। কেন কাজ করছে না সেটি বোঝার চেষ্টা করে লাভ নেই, সমুদ্রে পড়ে গিয়ে প্রচণ্ড ঝাঁকুনিতে কিছু একটা ঘটে গেছে, তন্তুটি বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে কিংবা বাতাসের চাপের সমতা নষ্ট হয়ে গেছে–কিন্তু সেটি এখন আর বিশ্লেষণ করার সময় নেই, সে নিশ্বাস নিতে পারছে না সেটিই হচ্ছে সবচেয়ে বড় কথা!
য়ুল হঠাৎ করে এক ধরনের ভয়াবহ আতঙ্ক অনুভব করে, সে আরো একবার নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করল এবং সঙ্গে সঙ্গে তার নাকে–মুখে লোনা পানি প্রবেশ করে। সে পাগলের মতো ছটফট করে উপরে উঠতে চেষ্টা করে কিন্তু কোনো লাভ হয় না, সমুদ্রের পানির আরো গতীরে নেমে যেতে থাকে। য়ুল নিশ্বাস নেবার জন্য আবার চেষ্টা করল কিন্তু নিশ্বাস নিতে পারল না। তার সমস্ত বুক একটু বাতাসের জন্য হাহাকার করতে থাকে, সে মুখ হা করে নিশ্বাস নেবার চেষ্টা করতে থাকে। ছটফট করতে করতে সে বুঝতে পারে সে চেতনা হারিয়ে ফেলছে, তার চোখের সামনে একটি কালো পরদা নেমে আসছে–সবকিছু শেষ হয়ে জীবনের ওপর যবনিকা নেমে আসছে! তা হলে এটাই কি মৃত্যু? এটাই কি শেষ?
য়ুলের দেহ শিথিল হয়ে আসে, সে পানির গভীরে নেমে যেতে থাকে, হিমশীতল পানিতে নিজের অজান্তেই তার দেহ কেঁপে কেঁপে উঠছে। তার অচেতন মস্তিষ্কে ছায়ার মতো দৃশ্য ভেসে যেতে থাকে। তার শৈশব–কৈশোর এবং যৌবনের দৃশ্য ছাড়া–ছাড়াভাবে মনে হয়, প্রিয়জনের চেহারা চোখের সামনে ভেসে ওঠে। বুকের মাঝে আটকে থাকা বদ্ধ নিশ্বাসে মনে হয় তার বুক ফেটে যাবে–এখন মৃত্যুই বুঝি শান্তি নিয়ে আসবে–সেই মৃত্যু কি এগিয়ে আসছে? কোমল চেহারার একটি অপার্থিব মানবী তার দিকে এগিয়ে আসছে, তার মুখের ওপর মুখ নামিয়ে মেয়েটি তার ঠোঁট স্পর্শ করল। এটাই কি মৃত্যু? য়ুল চোখ বন্ধ করল, সকল যন্ত্রণা হঠাৎ করে যেন দূর হয়ে গেল। বুকভরে সে যেন নিশ্বাস নিতে পারল। য়ুলের মনে হল তাকে ঘিরে অসংখ্য মানবী নৃত্য করছে। সে চোখ খুলে তাকানোর চেষ্টা করল, কিন্তু তাকাতে পারল না। হঠাৎ করে তার চোখের সামনে গাঢ় অন্ধকার নেমে এল।
এটিই কি মৃত্যু? য়ুল উত্তর খুঁজে পেল না
০৫.
নভোযানের নিরাপদ বিছানা থেকে উঠে বসে য়ুল অপরাধীর মতো কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমার জীবন রক্ষা করার জন্য তোমাকে অনেক ধন্যবাদ।
কীশ কোনো কথা বলল না, এক ধরনের ভাবলেশহীন মুখে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুল আবার বলল, আমি খুব দুঃখিত তোমাকে এত বড় ঝামেলার মাঝে ফেলে দেওয়ার জন্য।
কীশ এবারেও কোনো কথা বলল না, যদি সে একটি বায়োবট না হত তা হলে য়ুল নিশ্চয়ই ভাবত কীশ অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হয়ে আছে। য়ুল তার বিছানা থেকে নামার জন্য পা নিচে নামিয়ে বলল, কীশ, সত্যিই আমি খুব দুঃখিত–তুমি হয়তো বিশ্বাস করছ না, কিন্তু আমি সত্যিই বলছি।
আমি তোমার কথা অবিশ্বাস করছি না য়ুল– আমি তোমার প্রত্যেকটি কথা বিশ্বাস করেছি। তবে—
তবে কী?
আমার ধারণা ছিল আমি মানুষকে বুঝতে পারি, কিন্তু আজকে আমি আবিষ্কার করেছি যে আমি মানুষকে বুঝতে পারি না। মানুষের মাঝে নিজেকে নিজের ধ্বংস করে ফেলার একটা প্রবণতা রয়েছে। সম্পূর্ণ অকারণে মানুষ নিজেকে ধ্বংস করে ফেলে।