কীশ কিছুক্ষণ একা একা দাঁড়িয়ে থাকে, আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল নীল সমুদ্র দেখে য়ুলের ভিতরে হঠাৎ যে ধরনের আবেগের জন্ম হয়েছে কীশ তার সাথে পরিচিত নয়, তার পক্ষে সেটা অনুভব করাও সম্ভব নয়। য়ুল সমুদ্রতীর থেকে এখন খুব সহজে ফিরে যাবে বলে মনে হয় না। কীশ কিছুক্ষণ য়ুলকে লক্ষ্য করে ভাসমান যানটিতে ফিরে গেল মিছিমিছি সময় নষ্ট না করে, একটু আগে বিধ্বস্ত দালান থেকে সে যে ক্রিস্টাল ডিস্কটি উদ্ধার করেছে তার ভিতর থেকে কোনো তথ্য বের করা যায় কি না সেটাই চেষ্টা করে দেখবে।
কিছুক্ষণের মাঝেই কীশ ক্রিস্টাল ডিস্কে একটা বিচিত্র জিনিস আবিষ্কার করে, এখানে মানুষের ধ্বংস হয়ে যাওয়ার ঠিক আগে পৃথিবীতে কী হয়েছিল সে সম্পর্কে কিছু অস্পষ্ট তথ্য আছে। পৃথিবীর বাতাসের বিষক্রিয়া, পারমাণবিক বিস্ফোরণ, বিষাক্ত গ্যাসের কবল থেকে মানুষকে বাঁচানোর জন্য কী করা হয়েছিল তার আভাস দেওয়া আছে। সে সম্পর্কে তথ্য কোথায় পাওয়া যেতে পারে সেটি নিয়েও কিছু গোপন তথ্য রয়েছে।
কীশ খুব কৌতূহলী হয়ে ওঠে, ক্রিস্টাল ডিস্কটা হাতে নিয়ে সে দ্রুত পায়ে হেঁটে য়ুলের কাছে হাজির হল। য়ুল কীশকে দেখে একটু অবাক হয়ে বলল, কী হয়েছে কীশ! তোমাকে মানুষের মতো উত্তেজিত দেখাচ্ছে!
তুমি ঠিকই বলেছ। আমার ভিতরে উত্তেজনা থাকলে আমি মানুষের মতোই উত্তেজিত হতাম।
কেন? কী হয়েছে?
ক্রিস্টাল ডিস্কটা বিশ্লেষণ করে কিছু চমকপ্রদ তথ্য পেয়েছি।
কী তথ্য?
এই পৃথিবীতে মানুষের শেষ মুহূর্তের তথ্য। যখন মানুষ বুঝতে পেরেছে এই পৃথিবীতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারবে না, তখন তারা কী করেছে তার তথ্য।
য়ুল একটু চমকে উঠে কীশের দিকে তাকাল, কী করেছে?
আমি এখনো জানি না। এই ক্রিস্টাল ডিস্কে সেই তথ্য নেই, কিন্তু কোথায় আছে তার আভাস দেওয়া আছে।
সত্যি?
হ্যাঁ সত্যি। তোমার যদি আপত্তি না থাকে আমি সেটা খুঁজে বের করতে চাই।
আমার কোনো আপত্তি নেই।
তা হলে চল যাই।
য়ুল একটু ইতস্তত করে বলল, আমার সেই ধ্বংসস্তূপে যেতে ইচ্ছে করছে না। তুমি যাও আমি এখানে এই সমুদ্রতীরে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কীশকে কয়েক মুহূর্ত বেশ বিভ্রান্ত দেখায়। সে একটু ইতস্তত করে বলল, সেটা হয় য়ুল। নিরাপত্তা বিধানে স্পষ্ট করে লেখা আছে মানুষকে বিপজ্জনক পরিবেশে কখনো একা রাখতে হয় না।
য়ুল হেসে ফেলল, বলল, এটা মোটেও বিপজ্জনক পরিবেশ নয় কীশ! এটা পৃথিবী।
কিন্তু এটা বাসযোগ্য পৃথিবী নয় য়ুল। এই পৃথিবীতে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ ছাড়া তুমি এক মিনিটও বেঁচে থাকতে পারবে না।
কিন্তু আমার ফুসফুসে তো বিশুদ্ধ বাতাসই যাচ্ছে। একুশ ভাগ অক্সিজেন উনআশি ভাগ বিশুদ্ধ নাইট্রোজেন।
কিন্তু
কোনো কিন্তু নেই। তুমি যাও। ঐ মনখারাপ ঘরে তোমার যেটা খোজাখুঁজি করার ইচ্ছে সেটা খুঁজে বেড়াও। আমি এখানে তোমার জন্য অপেক্ষা করব।
কীশ কোনো কথা না বলে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল। য়ুল বলল, তা ছাড়া তোমার সাথে তো যোগাযোগ মডিউল রয়েছে, তুমি যেখানেই থাক আমাকে দেখতে পাবে। আমার সঙ্গে কথা বলতে পারবে। যদি সত্যিই কোনো বিপদ হয় তা হলে তুমি চলে এসো আমাকে উদ্ধার করার জন্য।
ঠিক আছে। আমি তা হলে যাচ্ছি। তুমি এখানে থাক–সমুদ্রের বেশি কাছে যাবে না।
যাব না।
তোমাকে কিছু খাবার পানীয় দিয়ে যাচ্ছি! এবং একটা অস্ত্র।
অস্ত্র?
হ্যাঁ, আমি জানি সেটা তোমার ব্যবহার করার কোনো প্রয়োজন হবে না, কিন্তু তবু দিয়ে যাচ্ছি। সাথে রেখো।
বেশ। য়ুল হেসে ফেলল, বলল, যদি সত্যি কোনো জীবন্ত প্রাণী আমাকে আক্রমণ করে সেটা কি একটা আনন্দের ঘটনা হবে না? তার অর্থ হবে পৃথিবীতে এখনো প্রাণ রয়েছে।
কীশ মাথা নাড়ল, বলল, সেটি তুমি সত্যিই বলেছ য়ুল। সেটি এক অর্থে আসলেই আনন্দের ঘটনা হবে। তবে তুমি যদি তখন নিজেকে রক্ষা করতে পার সেটি হবে দ্বিগুণ আনন্দের ঘটনা।
কিছুক্ষণের মাঝেই য়ুল দেখল প্রচণ্ড গর্জন কর ভাসমান যানটি বালু উড়িয়ে উত্তর দিকে যেতে শুরু করেছে।
০৪.
য়ুল একাকী সমুদ্রতীরে দাঁড়িয়ে থাকে, সামনে যত দূর চোখ যায় সমুদ্রের আশ্চর্য নীল জলরাশি। সে অন্যমনস্কভাবে বাম দিকে তাকাল। বহু দূরে আবছা ছায়ার মতো কিছু উঁচু নিচু পাহাড়, তার পাদদেশে সমুদ্রের বিশাল তরঙ্গ ঝাঁপটা দিয়ে পড়ছে। দৃশ্যটি নিশ্চয়ই অভূতপূর্ব–য়ুল নিজের অজান্তেই সেদিকে হাঁটতে শুরু করে। হাঁটতে হাঁটতে তার হঠাৎ একটি বিচিত্র জিনিস মনে হল। এক সময় এই পৃথিবীতে লক্ষকোটি মানুষ বেঁচে ছিল, এখন। এখানে সে একা। সমস্ত পৃথিবীতে সে একমাত্র জীবিত মানুষ–ব্যাপারটি সে কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারে না।
য়ুল হাঁটতে হাঁটতে একসময় উঁচু–নিচু পাহাড়ি এলাকার কাছাকাছি হাজির হল, ঢাল বেয়ে সে ধীরে ধীরে উপরে উঠে এসেছে, সমুদ্রের পানি নিচে পাথরে আছড়ে পড়ছে। য়ুল একটা বড় পাথরে বসে দীর্ঘসময় নিচে তাকিয়ে থাকে, তারপর আবার হাঁটতে রু করে। সামনে বড় পাথরের দেয়াল খাড়া উঠে গেছে, তার পাশ দিয়ে সরু চিলতে একটা ফুটো, একটু অসাবধান হলেই অনেক নিচে গিয়ে পড়বে। একা সম্ভবত এদিক দিয়ে যাওয়া উচিত নয়, হঠাৎ করে একটা দুর্ঘটনা হলে সর্বনাশ হয়ে যাবে। কিন্তু মূল কী ভেবে সেই সরু ফুটো দিয়ে পাথর আঁকড়ে হাঁটতে থাকে, কিছুক্ষণের মাঝেই সে একটা ভোলা অংশে চলে আসে। হঠাৎ করে খানিকটা জায়গা সমুদ্রের অনেক ভিতরে ঢুকে গেছে। য়ুল উঁচু–নিচু পাথর অতিক্রম করে সাবধানে সামনে এগিয়ে যায়, পাথরের একেবারে কিনারায় এসে সে দাঁড়াল, নিচে সমুদ্রের নীল পানি, পানির গভীরতা নিশ্চয়ই অনেক বেশি, কারণ এখানে কোনো বড় ঢেউ নেই। শান্ত বাতাসের সঙ্গে ছোট ঘোট নিরীহ ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে। তীরে যেরকম সমুদ্রের গর্জন শোনা যাচ্ছিল, এখানে সে রকম কিছু নেই। চারপাশে এক ধরনের সুমসাম নীরবতা, পরিবেশটি অনেকটুকু অতিপ্রাকৃত। য়ুল একটা বড় পাথরে হেলান দিয়ে দাঁড়াল এবং হঠাৎ তার মনে হল সে এখানে একা নয়। মূল কেমন যেন চমকে ওঠে, অনুভূতিটি এত জীবন্ত সে একবার মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল। চারপাশে কেউ কোথাও নেই, তবুও তার ভিতরে অন্য কারো উপস্থিতির অনুভূতিটি জেগে রইল।