ভাসমান যানটি বিস্তীর্ণ প্রাণহীন শুষ্ক মরু অঞ্চলের ওপর দিয়ে একটি বিধ্বস্ত শহরে প্রবেশ করল। কয়েক শ বছর থেকে এই শহরটি পরিত্যক্ত হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। শুকনো ধুলোবালুতে অনেক অংশ ঢেকে আছে, বড় বড় কিছু দালান ধসে পড়েছে, কোথাও দালানের কাঠামোটি মৃত মানুষের কংকালের মতো দাঁড়িয়ে আছে। শহরের রাস্তাঘাটে ফাটল, যেটুকু অক্ষত সেখানে ধ্বংসপ এবং জঙ্গল। স্থানে স্থানে কালো পোড়া অগ্নিদগ্ধ দালানকোঠা। সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর মন–খারাপ–করা দৃশ্য। কীশ যানটি একটি মোটামুটি অক্ষত দালানের কাছে স্থির করিয়ে য়ুলকে নিয়ে নেমে আসে। দালানের ভেঙ্গে পড়া, ধসে যাওয়া দেয়ালের ফাটল দিয়ে দুজন ভিতরে ঢুকল। কীশের মাথায় লাগানো উজ্জ্বল আলোতে চারদিক আলোকিত হয়ে যায়। ধূলিধূসর ঘরের ভিতরে ওরা চারদিকে তাকিয়ে দেখে ভেঙে যাওয়া আসবাবপত্র, যন্ত্রপাতি, যোগাযোগের যন্ত্রপাতি, প্রাচীন কম্পিউটার। কীশ তার যান্ত্রিক চোখ এবং গাণিতিক উৎসাহ নিয়ে একটি একটি জিনিস পরীক্ষা করতে থাকে, পুরোনো তথ্য ঘাঁটাঘাঁটি করে পৃথিবীতে ঠিক কী ঘটেছিল এবং ঠিক কীভাবে সব মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল কীশ সেটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করতে থাকে। এসব বিষয়ে কীশের ধৈর্য প্রায় সীমাহীন, য়ুল তার কাজকর্ম দেখে অবশ্য কিছুক্ষণেই উৎসাহ হারিয়ে ফেলল। সে কীশের কাছে গিয়ে বলল, কীশ আমি এই অন্ধকার ঘুপচি ঘরে বসে থাকতে চাই না।
তা হলে কী করতে চাও?
বাইরে থেকে ঘুরে আসি। এই ধ্বংস হয়ে যাওয়া শহরটা খুব মন খারাপ করা। আমি সমুদ্র তীরে গিয়ে বসি। সমুদ্রের পানি এখনো গাঢ় নীল। বসে বসে দেখতে মনে হয় ভালো লাগবে।
তুমি একটু অপেক্ষা করতে পারবে? আমি একটা ক্রিস্টাল ডিস্ক পেয়েছি, মনে হচ্ছে এর মাঝে কিছু তথ্য আছে।
থাকুক। এখানে আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে।
কীশ উঠে দাঁড়াল। বলল, তা হলে চল। আমি এখানে পরে আসব।
কীশ য়ুলকে নিয়ে আবার ভাসমান যানে উঠে বসল। সুইচ স্পর্শ করতেই ভাসমান যানের নিচে দিয়ে আয়োনিত গ্যাস বের হতে শুরু করে এবং ভাসমান যানটি সাবলীল গতিতে উপরে উঠে এসে ঘুরে দক্ষিণ দিকে সমুদ্রের তীরে যেতে শুরু করে। বিস্তীর্ণ বিবর্ণ পাথর পার হয়ে ধূলিধূসর একটা অঞ্চলে চলে আসে, সেই অঞ্চলটি পার হওয়ার পরই হঠাৎ করে আদিগন্তবিস্তৃত একটি বালুবেলা দেখা যায়। কীশ ভাসমান যানটির গতিবেগ বাড়িয়ে দেয়, পিছনে ধুলো উড়িয়ে তারা ছুটে যেতে থাকে, বাতাসে য়ুলের চুল উড়তে থাকে। কিছুক্ষণের মাঝে বিশুদ্ধ বাতাসের প্রবাহ ছাপিয়ে য়ুল তার নাকে সমুদ্রের নোনা পানির গন্ধ পেল। বহুদূরে নীল সমুদ্র দেখা যায়, য়ুল কেন জানি নিজের ভিতরে এক ধরনের চঞ্চলতা অনুভব করতে থাকে।
গ্যালাক্সির অন্য প্রান্ত থেকে য়ুল তার বুকের ভিতরে করে পৃথিবীর জন্য ভালবাসা নিয়ে এসেছিল। শুষ্ক বিবর্ণ বিধ্বস্ত পৃথিবীর ধ্বংসস্তূপে সে এই ভালবাসা দিতে পারছিল না। নীল সমুদ্র দেখে হঠাৎ তার ভিতরে সম্পূর্ণ ভিন্ন এক ধরনের আবেগের জন্ম হয়, সে আবিষ্কার করে নিজের অজান্তেই তার চোখ ভিজে আসছে।
সমুদ্রের ভেজা বালুতে ভাসমান যানটিকে থামিয়ে য়ুল এবং কীশ নেমে এল। য়ুল সমুদ্রের দিকে এগিয়ে মুগ্ধ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, আহা! কী সুন্দর।
কীশ নরম গলায় বলল, আমি শুনে খুব খুশি হয়েছি য়ুল যে এই সমুদ্রটি দেখে তোমার এত ভালো লাগছে!
য়ুল অবাক হয়ে বলল, তোমার ভালো লাগছে না?
লাগছে। কিন্তু আমি তো মানুষ নই–আমার সৌন্দর্যের অনুভূতি ভিন্ন। তোমাদের মতো এত ব্যাপক নয়–অনেক নিচু স্তরের অনুভূতি।
য়ুল মাথা নেড়ে হেঁটে হেঁটে সামনের দিকে এগিয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ একটি একটি করে এগিয়ে আসছে, কাছাকাছি আসার পর সাদা ফেনা তুলে আছড়ে পড়ছে। ভেজা বালুতে কিছু শামুক এবং জলজ লতাপাতা। য়ুল হেঁটে হেঁটে পানির কাছাকাছি দাঁড়াল, ঢেউ তার কাছাকাছি এসে পায়ের কাছে ভেঙে পড়ল–য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের শিহরন অনুভব করে।
য়ুল আরো এক পা এগিয়ে যেতেই কীশ পিছন থেকে সতর্ক করে বলল, বেশি কাছে যেও না য়ুল, ঢেউয়ের আঘাতে তোমাকে পানিতে টেনে নেবে।
য়ুল মাথা নাড়ল, বলল, নেবে না। মানুষের শরীরের অর্ধেক থেকে বেশি পানি। পানির সাথে মানুষের এক ধরনের ভালবাসা আছে। আমি শুনেছি। প্রাচীনকালে পানিকে নাকি বলত জীবন!
কীশ একটু এগিয়ে এসে বলল, তবু সাবধান থাকা ভালো। ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জে এরকম সমুদ্র নেই, এত পানি একসাথে আমরা কখনো দেখি নি। পানির সাথে কীভাবে বেঁচে থাকতে হয় তুমি–আমি জানি না।
য়ুল অন্যমনস্কভাবে বলল, কিছু জিনিস মনে হয় মানুষের সহজাত প্রবৃত্তি। পানির সাথে ভালবাসা হচ্ছে একটা। তুমি তো জান পৃথিবীতে প্রথম প্রাণের বিকাশ হয়েছিল পানিতে।
জানি।
আগে ব্যাপারটা খুব অবাক লাগত। এখন এই বিশাল আদিগন্ত বিস্তৃত নীল সমুদ্র দেখে মনে হচ্ছে সেটাই তো স্বাভাবিক। সেটাই তো সত্যি।
কীশ কোনো কথা বলল না। য়ুল ভেজা পানিতে পা ভিজিয়ে সমুদ্রের ঢেউয়ের কাছাকাছি হাঁটতে থাকে। এক একটি ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তার পায়ের কাছে আছড়ে পড়তেই সে তার নিজের ভিতরে এক বিচিত্র আবেগ অনুভব করে। সমুদ্রের নোনা বাতাসে তার চুল, নিও পলিমারের পোশাক উড়তে থাকে। য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের বিষণ্ণতা অনুভব করে, এক সময় এই সমুদ্রতট মানুষের কলকাকলীতে মুখরিত হয়ে থাকত, সেই কথাটা সে কিছুতেই ভুলতে পারে না।