ক্রন আন্তঃগ্রহ নভোযানে এসে কীশ এবং য়ুলকে তাদের নিজস্ব আসনে বসিয়ে নিরাপত্তা–বাঁধন দিয়ে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে দেয়। তারপর মূল দরজা বন্ধ করে তাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়। কিছুক্ষণের মাঝেই য়ুল নভোযানের ইঞ্জিনের গর্জন শুনতে পেল। নভোযানটি ধীরে ধীরে মূল মহাকাশযান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে। য়ুল গোল স্বচ্ছ জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে থাকে, নভোযানটি বাতাসের ঘর্ষণে কেঁপে কেঁপে উঠছে, তার পৃষ্ঠদেশ বাতাসের তীব্র ঘর্ষণে উজ্জ্বল রক্তবর্ণ ধারণ করেছে। তাপ নিরোধক আস্তরণ থাকার পরও য়ুল মহাকাশযানের উষ্ণতা অনুভব করে। আকাশ কুচকুচে কালো থেকে প্রথমে বেগুনি, তারপর গাঢ় নীল এবং সবশেষে হালকা নীল হয়ে এসেছে। য়ুল নিচে তাকাল, গাঢ় নীল সমুদ্র, সাদা মেঘ এবং বহুদূরে ধূসর স্থলভূমি। য়ুলের এখনো বিশ্বাস হতে চায় না এই গ্রহটিতে তার পূর্বপুরুষের জন্ম হয়েছিল এবং সেই পূর্বপুরুষ গ্রহটিকে জীবনের অনুপযোগী করে ধ্বংস করে ফেলেছে।
নভোযানটি থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে আরো নিচে নেমে আসে, গতিবেগ কমে এসেছে, মহাকাশযানের জানালা দিয়ে সাদা মেঘগুলোকে অতিপ্রাকৃতিক দৃশ্যের মতো মনে হয়, পৃথিবী ছাড়া আর কোথাও এই দৃশ্য দেখা সম্ভব বলে মনে হয় না।
কীশ কন্ট্রোল প্যানেল থেকে মাথা তুলে ঝুলের দিকে তাকিয়ে বলল, য়ুল।
বল।
আমরা গতিবেগ আরো কমিয়ে নামার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছি। শব্দের বাধা অতিক্রম করার সময় একটি ঝাঁকুনি হতে পারে।
ঠিক আছে। কোথায় নামবে?
এখনো ঠিক করি নি। কোনো প্রাচীন শহরের কাছাকাছি যেখানে সভ্যতার চিহ্ন পাওয়া যাবে।
য়ুল একটি নিশ্বাস ফেলল, কোনো কথা বলল না।
নভোযানটি সমুদ্রের তীরে একটি বড় প্রাচীন শহরের কাছে যখন খুব ধীরে ধীরে অবতরণ করল, তখন পৃথিবীর সেই জায়গায় সন্ধ্যা নেমে এসেছে। য়ুল তার আসন থেকে মুক্ত হয়ে জানালার কাছে দাঁড়াল, গোধূলির নরম আলোকে পৃথিবীকে কী রহস্যময়ই না। লাগছে! সে যে ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে এসেছে সেখানে কখনো এ রকম আঁধার নেমে আসে না, সেখানে সারাক্ষণ তীব্র কৃত্রিম আলোয় আলোকিত থাকে। আলোহীন এক বিচিত্র অন্ধকার দেখে অনভ্যস্ত য়ুল নিজের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে।
কীশ যন্ত্রপাতি খুলে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলকে পরীক্ষা করতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মাঝেই সে নিশ্চিত হয়ে যায় শ্বাস–প্রশ্বাসের কৃত্রিম একটা ব্যবস্থা না করে এখানে মূল বের হতে পারবে না। কীশ আর্কাইভ ঘর থেকে অক্সিজেন সাপ্লাই, গ্যাস পরিশোধন যন্ত্র বের করে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে নিশ্বাস নেবার জন্য একটি কৃত্রিম ব্যবস্থা দাঁড় করাতে শুরু করে। য়ুল কীশের দক্ষ হাতের কাজ দেখতে দেখতে বলল, কীশ।
বল য়ুল।
তুমি বলছ এখানে কোনো জীবিত মানুষ নেই। কিন্তু এমন তো হতে পারে পৃথিবীর কোনো একটি কোনায় এক–দুইজন মানুষ বেঁচে আছে। নিরিবিলি, কারো সাথে কোনো সম্পর্ক নেই?
কীশের যান্ত্রিক মুখে সমবেদনার চিহ্ন ফুটে ওঠে। সে নরম গলায় বলল, তার সম্ভাবনা বলতে গেলে নেই। পৃথিবীর বাতাসে বেঁচে থাকার মতো যথেষ্ট অক্সিজেন নেই।
হয়তো তারা কৃত্রিম নিশ্বাস নেবার ব্যবস্থা করে বেঁচে আছে, হয়তো—
তুমি কী বলতে চাইছ য়ুল। বলে ফেল।
য়ুল একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মনে কর আমার সাথে যদি কারো দেখা হয়, আমি তার সাথে কীভাবে কথা বলব? গত কয়েক শতাব্দীতে ভাষার কত পরিবর্তন হয়েছে–
কীশ কয়েক মুহূর্ত য়ুলের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, আমি নিশ্চিত তোমার সাথে কারো দেখা হবে না। কিন্তু তুমি যদি সত্যিই চাও, তা হলে তোমার মানসিক শান্তির জন্য আমি তোমার জন্য একটি ভাষা অনুবাদক দাঁড় করিয়ে দেব। পৃথিবীর যে কোনো কালের মানুষের ভাষা বোঝা নিয়ে তোমার কোনো সমস্যা হবে না।
ধন্যবাদ কীশ। তোমাকে অনেক ধন্যবাদ। আমি জানি আমি এটি ব্যবহার করার সুযোগ পাব না, তবুও কাল ভোরে বের হওয়ার সময় আমি এটা সাথে রাখতে চাই।
কীশ স্থির দৃষ্টিতে য়ুলের দিকে তাকিয়ে রইল, কোনো কথা বলল না।
০৩.
ভাসমান যানটিতে কীশের পাশে য়ুল স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, এমনিতে দেখে বোঝা যায় না, খুব ভালো করে লক্ষ করলে দেখা যাবে তার নাকের মাঝে সূক্ষ্ম এক ধরনের তন্তু প্রবেশ করেছে, তন্তু দুটি পৃথিবীর বিষাক্ত গ্যাসকে পরিশোধন করে নিশ্বাসের জন্য বিশুদ্ধ বাতাস সরবরাহ করছে। তার কানে ক্ষুদ্র মডিউলটিতে ভাষা অনুবাদকটি বসিয়ে দেওয়া আছে, পৃথিবীর যে কোনো মানুষের ভাষা সেটি তাকে অনুবাদ করে দেবে। গলার ভোকাল কর্ডের ওপর শব্দ উপস্থাপক যন্ত্রটি য়ুলের কথাকেও মানুষের যে কোনো ভাষায় অনুবাদ করে দেবে। কীশ নিশ্চিত যে য়ুল এই যন্ত্রটি ব্যবহার করার সুযোগ পাবে না কিন্তু য়ুল সেটি এখনো পুরোপুরি বিশ্বাস করে নি।
ভাসমান যানটি পৃথিবীপৃষ্ঠের খুব কাছে গিয়ে দ্রুতগতিতে ছুটে যাচ্ছে, সামনে নানা ধরনের মনিটর, সেগুলো জীবন্ত প্রাণীকে খোঁজার চেষ্টা করছে। কিছু কীটপতঙ্গ এবং অত্যন্ত নিম্নশ্রেণীর সরীসৃপ ছাড়া পৃথিবীতে কোনো প্রাণের চিহ্ন নেই। নিচে শুষ্ক মাটি, শৈবাল এবং ফার্ন জাতীয় কিছু উদ্ভিদ বিচ্ছিন্নভাবে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। কীশ তা সংরক্ষণের জন্য বেশ উৎসাহ নিয়ে কীটপতঙ্গ থেকে শুরু করে শৈবাল এবং ফার্নের নমুনা সংগ্রহ করছে, য়ুল এক। ধরনের ঔদাসীন্য নিয়ে কীশের কাজকর্ম লক্ষ করে। পৃথিবী সম্পর্কে তার ভিতরে যে স্বপ্ন ছিল তা পুরোপুরি যন্ত্রণায় পাল্টে গিয়ে তাকে এক ধরনের অস্থিরতায় ডুবিয়ে ফেলছে।