কেউ একজন হাসল। কে হাসল? কেন হাসল? কয়েস নিজের এলোমলো ভাবটা বিন্যস্ত করে জেগে ওঠার চেষ্টা করে, কী হচ্ছে বোঝার চেষ্টা করে। জানতে চায়, আমি কোথায়?
কয়েস স্পষ্ট শুনতে পেল কেউ একজন বলল, আমি বলে কিছু নেই।
কয়েস চমকে ওঠে, কে কথা বলে?
কেউ না।
কেউ না?
না।
তুমি কে?
তুমি বলেও কিছু নেই। আমি তুমি বলে কিছুই নেই। সবাই এক।
কয়েস ছটফট করে ওঠে, আমি কাউকে দেখতে পাচ্ছি না কেন?
দেখা! দেখার মানে হচ্ছে কোনো কিছু থেকে প্রতিফলিত আলোর চোখের রেটিনায় এক ধরনের সংবেদন সৃষ্টি করা, যেটা মস্তিষ্ক ব্যাখ্যা করতে পারে। পুরো ব্যাপারটি নির্ভর করে কিছু জৈবিক প্রক্রিয়ার ওপর। একটা জিনিস মানুষ দেখে একভাবে, পশুপাখি দেখে অন্যভাবে, কীটপতঙ্গ দেখে আবার সম্পূর্ণ ভিন্নভাবে। কাজেই তুমি যখন বলছ দেখতে পাচ্ছ তার অর্থ খুব অস্পষ্ট। দেখা ব্যাপারটি অস্পষ্ট! সত্যি কথা বলতে কী, দেখা ব্যাপারটি অত্যন্ত আদিম একটা প্রক্রিয়া–
কয়েস বলল, তবু আমি দেখতে চাই। মানুষের মতো দেখতে চাই।
বেশ! দেখতে চাইলেই দেখা যায়।
কয়েস দেখতে চাইল এবং হঠাৎ করে সবকিছু তার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠল। কয়েস একসাথে পুরো পৃথিবীটা দেখতে পায়। পৃথিবীর গাছপালা, নদী, সাগর, আকাশ–বাতাস, কীটপতঙ্গ, পশুপাখি, মানুষ, মানুষের বসতি, শহর নগরী সবকিছু দেখতে পেল। সবকিছু তার সামনে স্থির হয়ে আছে, যেন পুরো পৃথিবীটা তার সামনে স্থির হয়ে আছে। যেন পৃথিবীটাকে কেউ থামিয়ে দিয়েছে।
কয়েস অবাক হয়ে দেখে–সম্পূর্ণ নতুনভাবে দেখা, যেটি সে আগে কখনো দেখে নি। কয়েস নিজের ভিতরে এক ধরনের অস্থিরতা অনুভব করে–সে তো এতকিছু এভাবে দেখতে চায় নি।
তা হলে কী দেখতে চেয়েছ?
আমি নদীতীরে মাজহার নামের মানুষটিকে দেখতে চেয়েছি। সে আমার মাথায় রিভলভার ধরে রেখেছিল। যার আসল নাম মাজহার নয়–যার নাম মাওলা। মাওলা বকশ–
বেশ।
কয়েস সাথে সাথে মাজহারকে দেখতে পেল। হাতে একটি বেঢপ রিভলভার চেপে নিয়ে নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছে। চেহারায় এক ধরনের কাঠিন্য। তার পায়ের কাছে একটি দেহ কুঁকড়ে শুয়ে আছে। দেহটিকে চিনতে পারল–তার নিজের দেহ। কয়েস অবাক হয়ে দেখল মাজহার স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, রিভলবারের নল থেকে যে ধোঁয়া বের হয়েছে সেটিও স্থির হয়ে আছে। আকাশে আধখানা চাঁদ তার মাঝে কোমল এক ধরনের কুয়াশা। নদীর পানি কাঁচের মতো স্থির। কয়েস আতঙ্কে কেমন যেন শিউরে উঠল। ভাবল, তা হলে কি আমি মরে গেছি?
কেউ একজন আবার নিচু গলায় হাসল। কে হাসে? কয়েস চিৎকার করে জিজ্ঞেস করতে চাইল তা হলে কি আমাকে মেরে ফেলেছে? আমি কি মৃত? আমি তুমি বলে কিছু নেই। আসলে জন্ম–মৃত্য বলেও কিছু নেই। এখানে সবাই মিলে একটি প্রাণ। একটি অস্তিত্ব। একটি প্রক্রিয়া।
প্রক্রিয়া?
হ্যাঁ। সেই প্রক্রিয়ার তুমি একটি অংশ। মাজহার একটি অংশ। মাজহার ইচ্ছে করলে আমি হতে পারে, তুমিও ইচ্ছে করলে মাজহার হতে পার। তোমরা আসলে একই মানুষ। একই প্রাণের অংশ। একই অস্তিত্বের অংশ।
কয়েস অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে তাকিয়ে রইল। যে মানুষটি তাকে হত্যা করেছে সেই মানুষটি এবং সে নিজে একই মানুষ? কিন্তু সবাই স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে কেন?
কারণ সময়কে থামিয়ে রাখা হয়েছে।
সময়কে চালিয়ে দেওয়া যাবে?
উত্তর পেতে তার একটু দেরি হল। দ্বিধান্বিত স্বরে কেউ একজন বলল, হ্যাঁ। যাবে।
কয়েস নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করে। আশ্চর্য এক ধরনের শূন্যতা, আদি–অন্তহীন নিঃসীম এক ধরনের শূন্যতা। সে ক্লান্ত গলায় অনিশ্চিত স্বরে বলল, তুমি কে আমার সাথে কথা বলছ?
কেউ একজন হাসল। হেসে বলল, আমি কেউ না। আমার আলাদা কোনো অস্তিত্ব নেই। আমি হচ্ছি তুমি। তুমি হচ্ছ আমি। তুমি নিজের সাথে কথা বলছ।
আমি নিজের সাথে কথা বলছি?
হ্যাঁ, তুমি নিজের সাথে কথা বলছ।
কয়েস খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, আমি আর মাজহার একই অস্তিত্ব?
হ্যাঁ। তোমরা একই অস্তিত্ব। তোমরা একই মানুষ।
আমি মাজহারকে বুঝতে চাই।
কী বুঝতে চাও?
কেমন করে সে এত নিষ্ঠুর হয়? এত অমানুষ হয়?
কেউ একজন আবার হাসল। হেসে বলল, তোমার বিশাল অস্তিত্বে এইসব অর্থহীন। এইসব তুচ্ছ! তোমার মুক্তি হয়েছে। তুমি জান এইসব হচ্ছে ছোট ছোট পরীক্ষা। ছোট ছোট কৃত্রিম প্রক্রিয়া–
কয়েস বাধা দিয়ে বলল, আমি তবু মাজহারকে বুঝতে চাই।
সেটি হবে অপ্রয়োজনীয় একটি প্রক্রিয়া। অর্থহীন মূলাহীন একটি প্রক্রিয়া।
আমি তবু বুঝতে চাই।
কেউ একজন দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, বেশ।
হঠাৎ করে কয়েস আবিষ্কার করল সে আসলে কয়েস নয়, সে মাজহার। তার আসল নাম মাওলা বকশ। সে একটা জুটমিলের মেকানিক। তার একটি কমবয়সী স্ত্রী রয়েছে। বখে যাওয়া একটি পুত্র রয়েছে। মাজহারের শৈশবকে মনে পড়ল তার। শৈশবের দুঃসহ জীবন, অমানুষিক নির্যাতন, বেঁচে থাকার সম্রামের কথা মনে পড়ল। আনন্দহীন ভালবাসাহীন একটি নিষ্ঠুর জীবনের কথা মনে পড়ল। দুঃখ–কষ্ট–নির্যাতন আর অপমানে নিজেকে পাষাণ হয়ে যেতে দেখল। ঘৃণায় এবং জিঘাংসায় নিজেকে ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে দেখল। কয়েস তার নিজের সাথে, মাজহারের সাথে কথা বলল–তাকে বুঝতে চাইল। তাকে সে বুঝতে পারল না। তবুও সে তার মনের গহিনে, মস্তিষ্কের আনাচে–কানাচে, চেতনার সীমানায় ঘুরে বেড়াল। একসময় সে ক্লান্ত হয়ে বলল, আমি আর মাজহার হয়ে থাকতে চাই না।