মাজহার সাহেব! কয়েস কাতর গলায় বলল, বিশ্বাস করেন, আপনাকে সব টাকা আমি বুঝয়ে দিব। আপনি যেখানে চাইবেন, যেভাবে চাইবেন।
চুপ কর। মাজহার ধমক দিয়ে কয়েসকে থামানোর চেষ্টা করল।
কয়েস তবু হাল ছাড়ল না, অনুনয় করে বলল, বিশ্বাস করেন, পৃথিবীর কেউ জানবে না। আমি একেবারে উধাও হয়ে যাব। দেশ ছেড়ে চলে যাব–আপনি আপনার বান্ধা কাজ করে যাবেন। কেউ একটা কথা জানবে না। খোদার কসম।
মাজহার কোনো কথা বলল না। কয়েস কাতর গলায় বলল, চল্লিশ হাজার না মাজহার সাহেব, আমি আপনাকে পুরো পঞ্চাশ হাজার টাকা দিব। এক শ টাকার নোট। পঞ্চাশ হাজার টাকা।
চুপ কর শালা, বেশি কথা বলিস না। তোর টাকায় আমি পিশাব করে দিই।
মাজহার সাহেব, আমাকে ছেড়ে দেন, আমি আপনার জন্য দোয়া করব। আল্লাহর কাছে দোয়া করব।
নিজের জন্য দোয়া কর।
মাজহার সাহেব, বিশ্বাস করেন আমি কিছু করি নাই। আমি নির্দোষ। আমারে ভুল করে ধরেছেন, কী একটা ভুল হয়েছে। আমার স্ত্রী আছে, ছোট ছেলে আছে। দুই বছরের ছেলে–এতিম হয়ে যাবে। আমারে মারবেন না মাজহার সাহেব। আল্লাহর কসম
মাজহার পা তুলে কয়েসের পিঠে একটা লাথি দিয়ে বলল, চুপ কর হারামজাদা।
কয়েস তাল হারিয়ে পড়ে যেতে যেতে কোনোমতে নিজেকে সামলে সোজা হয়ে দাঁড়াল। ভাঙা গলায় বলল, মাজহার সাহেব। আপনার কাছে আমি প্রাণ ভিক্ষা চাই। শুধু আমার প্রাণটা ভিক্ষা দেন। আমি আপনার গোলাম হয়ে থাকব। কেনা গোলাম হয়ে থাকব। সারা জীবনের জন্যে গোলাম হয়ে থাকব।
মাজহার কোনো কথা বলল না। কয়েস কাতর গলায় বলল, সারা জীবন আপনার গোলাম হয়ে থাকব। আপনি যা চাইবেন তাই দিব আপনাকে। বিশ্বাস করেন, আমার সম্পত্তি যা আছে–
মাজহার খেঁকিয়ে উঠে বলল, কেন শালার ব্যাটা তুই ঘ্যানঘ্যান করছিস? তুই জানিস না ঘ্যানঘ্যান করে কোনো লাভ নাই? মানুষের ঘ্যানঘ্যান প্যানপ্যান শুনে আমার কান পচে গেছে। এই নদীর ঘাটে আমি কত মানুষ খুন করেছি তুই জানিস?
জানি না মাজহার সাহেব। আমি জানতে চাইও না। আপনি একটা কম খুন করেন। মাত্র একটা। আপনার কসম লাগে।
মাজহার কোনো উত্তর দিল না, একটা নিশ্বাস ফেলে চুপ করে গেল। তারা নদীর তীরে এসে গেছে। এই ঘ্যানঘ্যানে কান্না এখনই শেষ হয়ে যাবে। ব্যাটাকে কথা বলতে দেওয়াই ভুল হয়েছে, ভবিষ্যতে আর কাউকে কথা বলতে দেবে না। মরে যাওয়ার আগে একেকজন মানুষ একেকরকম চিড়িয়া হয়ে যায় কী যন্ত্রণা!
মাজহার নদীর তীরে দাঁড়িয়ে কয়েসের পিছনে হাত দিয়ে বলল, এইখানে দাঁড়া।
কয়েস দাঁড়িয়ে গেল, হঠাৎ করে সে বুঝতে পারল সে তার জীবনের শেষ মুহূর্তে এসে পৌঁছেছে। তার সারা শরীর অবশ হয়ে আসে, হঠাৎ করে মনে হতে থাকে আর কিছুতেই বুঝি কিছু আসে–যায় না। চারদিকে নরম একটা জ্যোৎস্না, হেমন্তের হালকা কুয়াশা, নদীর পানিতে বহু দূরে গ্রামের টিমটিমে কয়েকটা আলোর প্রতিফলন, ঝিঁঝির একটানা ডাক কিছুই এখন আর তার চেতনাকে স্পর্শ করছে না।
মাজহার পিছন থেকে কয়েসের কাধ স্পর্শ করে বলল, হাঁটু গেড়ে বস।
কয়েস অনেকটা যন্ত্রের মতো হাঁটু গেড়ে বসল, সে আর কিছু চিন্তা করতে পারছে না। মাজহার কঠিন গলায় বলল, মাথা নিচু কর।
কয়েস মাথা নিচু করল। মাজহার এবার হেঁটে তার সামনে এসে দাঁড়াল, কয়েস একটা ধাতব শব্দ শুনতে পায়, চোখ না তুলেও সে বুঝতে পারে মাজহার তার হাতে রিভলবারটি তুলে এনেছে। মাজহার ভাবলেশহীন গলায় বলল, এখন মাথা উঁচু কর।
কয়েস মাথা উঁচু করল এবং এই প্রথমবার মাজহারকে দেখতে পেল, জ্যোৎস্নার আলোতে চেহারার সূক্ষ্ম ব্যাপারগুলো চোখে পড়ে না কিন্তু যেটুকু চোখে পড়ে তাতে কয়েসের মনে হল মানুষটি সুদর্শন। ছোটখাটো আকার, গলায় একটি কালচে মাফলার ঝুলছে। ডান হাতে একটা বেঢপ রিভলবার কয়েসের কপাল লক্ষ্য করে ধরে রেখেছে। জ্যোৎস্নার আবছা আলোতে মানুষটির চোখ স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে না, কিন্তু যেটুকু দেখা যাচ্ছে সেটুকু দেখে কয়েসের বুকের ভিতর শিরশির করে উঠল।
মাজহার নিচু গলায় বলল, দ্যাখ–তুই এখন নড়িস না তা হলে সোজা কাজটা কঠিন হয়ে যাবে। চুপচাপ বসে থাক, কিছু বোঝার আগেই সব শেষ হয়ে যাবে। এই কাজ আমি অনেকবার করেছি, কীভাবে ঠিক করে করতে হয় আমি জানি। তোর উপরে আমার কোনো রাগ নাই, এইটা হচ্ছে একটা বিজনেস।
কয়েস কাঁপা গলায় বলল, মাজহার ভাই
মাজহার বাধা দিয়ে বলল, আমার নাম আসলে মাজহার না–
কথা শেষ করার আগেই মাজহার ট্রিগার টেনে ধরে। নির্জন নদীতীরে একটা ভোঁতা শব্দ হল। কয়েস সেই শব্দটি শুনতে পেল না কারণ বুলেটের গতি শব্দের চেয়ে বেশি।
.
ওর নামটা আসলে মাজহার নয়, ওর আসল নাম মাওলা। মাওলা বকশ। কয়েস অবাক হয়ে ভাবল, আমি সেটা কেমন করে জানলাম? ঝিঁঝি পোকার কর্কশ ডাক শোনা যাচ্ছিল, হঠাৎ করে সব নীরব হয়ে গেল কেন? কোনো কিছু শুনতে পাচ্ছি না কেন? তা হলে কি আমি মরে গেছি?
কয়েসের স্পষ্ট মনে আছে মাজহার নামের মানুষটা, যার আসল নাম মাওলা বকশ– তার কপালের দিকে একটা রিভলবার তাক করে ধরে রেখেছিল, ট্রিগার টানার পর সে একটা আলোর স্ফুলিঙ্গ দেখতে পেল, তারপর সবকিছু কেমন জানি এলোমেলো হয়ে গেছে। তা হলে সে কি মরে গেছে? মরে গিয়ে থাকলে সে কেমন করে চিন্তা করছে?