রং করিস আমার সাথে? শালা তুই বুঝিস নাই কী করব?
কয়েস কোনো উত্তর দিল না, সে বুঝতে পারছে কিন্তু বিশ্বাস করতে চাইছে না। নিজের কানে একবার শুনতে চাইছে। সে আরো কয়েক পা নিঃশব্দে হেঁটে গিয়ে বলল, কী করবেন?
মানুষটি হঠাৎ রেগে গেল, রেগে চাপা গলাইয় চিৎকার করে বলল, শুনবি কী করব তোকে? শুনবি? শোন তা হলে। তোকে নিয়ে নদীর ঘাটে দাঁড় করিয়ে মাথার মাঝে একটা গুলি করব। বুঝেছিস?
কয়েসের সারা শরীর অবশ হয়ে ওঠে, হঠাৎ করে তার মনে হয় সে বুঝি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবে। কষ্ট করে সে দুই পায়ের উপর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে নিজেকে টেনে যন্ত্রের মতো হেঁটে যেতে থাকে। আরো কয়েক পা এগিয়ে গিয়ে কয়েস নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, আমাকে কেন গুলি করবেন? আমি কী করেছি?
তুই কী করেছিস আমার সেটা জানার কথা না। আমাকে বলছে তোর লাশ ফেলতে, আমি তোর লাশ ফেলব।
কিন্তু আপনার খারাপ লাগবে না?
খারাপ? পিছনের মানুষটা হঠাৎ যেন খুব অবাক হয়ে গেল, খারাপ কেন লাগবে?
কারণ, আমি মানুষটা হয়তো খারাপ না। হয়তো আমি ভালো মানুষ। নির্দোষ মানুষ–
পিছনের মানুষটা আবার শব্দ করে হেসে উঠল। বলল, তুই ভালো না খারাপ, দোষী না নির্দোষ, তাতে আমার কী আসে–যায়? আমাকে একটা কাজ দিয়েছে সেই কাজ করছি।
কেন করছেন?
পিছনের মানুষটা হঠাৎ ধৈর্য হারিয়ে বেঁকিয়ে উঠল, চুপ কর হারামজাদা। বকর বকর করিস না।
কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে কয়েস আবার জিজ্ঞেস করল, আপনার নাম কী?
পিছনের মানুষটা কয়েসের প্রশ্ন শুনে এত অবাক হল যে, রাগ হতে ভুলে গিয়ে হকচকিয়ে বলল, কী বললি?
আপনার নাম?
আমার নাম দিয়ে তুই কী করবি?
এমনি জানতে চাই।
জেনে কী করবি?
কিছু করব না। জানতে ইচ্ছে করছে। কয়েস অনুনয় করে বলল, বলবেন?
কয়েস ভেবেছিল মানুষটি তার নাম বলবে না, কিন্তু তাকে অবাক করে দিয়ে মানুষটা উত্তর দিল, বলল, মাজহার।
কয়েস নিচু গলায় জিজ্ঞেস করল, এইটা কি আপনার সত্যি নাম?
মাজহার পিছন থেকে কয়েসকে রূঢ়ভাবে ধাক্কা দিয়ে বলল, সেই কৈফিয়ত আমার তোকে দিতে হবে নাকি?
কয়েস ধাক্কা সহ্য করে নরম গলায় বলল, রাগ করবেন না মাজহার ভাই। আসলে এইটা আপনার সত্যি নাম না হলেও কোনো ক্ষতি নেই। কথা বলার জন্য একটা নাম লাগে, সেই জন্যে। এ ছাড়া আর কিছু না।
তোকে কথা বলতে বলেছে কে?
কেউ বলে নাই।
তা হলে?
তবু কথা বলতে ইচ্ছা করছে। কিছু মনে নিবেন না মাজহার সাহেব।
কয়েস তার পিছনে দাঁড়ানো মানুষটিকে একবারও দেখে নি, মানুষটি দেখতে কী রকম সে সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। পায়ের শব্দ এবং মাঝে মাঝে কাপড়ের খসখস শব্দ শুনতে পাচ্ছে। হঠাৎ করে মানুষটিকে দেখতে ইচ্ছে হল কয়েসের। হাঁটতে হাঁটতে মাথা ঘুরিয়ে দেখার চেষ্টা করল সে, সাথে সাথে মাজহার নাইলনের দড়ির বাড়তি অংশটুকু দিয়ে শপাং করে তার মুখে মেরে বসে। যন্ত্রণায় কাতর একটা শব্দ করল কয়েস, মাজহার হিস হিস করে বলল, খবরদার পিছনে মাথা ঘুরাবি না। খবরদার।
কয়েস মাথা নাড়ল, বলল, ঠিক আছে আর ঘুরাব না। আর ঘুরাব না।
দুইজন আবার চুপচাপ খানিকক্ষণ হেঁটে যায়। নির্জন রাস্তায় শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ নেই। দূরে কোথাও ঝিঁঝি পোকা ডাকছে। অনেক দূরে কোথাও একটি কুকুর ডাকল, হঠাৎ করে পুরো ব্যাপারটিকে কয়েসের কাছে কেমন জানি অতিপ্রাকৃত বলে মনে হতে থাকে। সে নিচু গলায় বলল, মাজহার সাহেব।
মাজহার কোনো উত্তর দিল না। কয়েস আবার ডাকল, মাজহার সাহেব।
কী হল?
আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
কী কথা?
আমাকে মেরে আপনি কী পাবেন?
টাকা।
কত টাকা?
সেটা শুনে তুই কী করবি?
জানার ইচ্ছা করছে।
জেনে কী করবি? তুই শালা আর দশ মিনিট পরে মরে ভূত হয়ে যাবি—
তবু শোনার ইচ্ছা করছে।
দুই।
দুই কী?
দুই হাজার।
কয়েস একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মাত্র দুই হাজার টাকার জন্য আপনি আমারে মারবেন?
মাজহার রেগে উঠল, তুই শালা কোন লাট সাহেব যে তোরে মেরে আমি দুই লাখ টাকা পাব?
কয়েস নরম গলায় বলল, আপনি আমারে ছেড়ে দেন মাজহার সাহেব, আপনারে আমি বিশ হাজার টাকা দিব।
মাজহার হা হা করে হেসে উঠল, তুই বিশ হাজার টাকা দিবি?
জে। দিব, খোদার কসম।
কীভাবে দিবি?
আপনি যেখানে বলবেন সেইখানে পৌঁছে দেব।
মাজহার কয়েসের পিছন থেকে তার মাথায় একটা চাঁটি মেরে বলল, তুই আমারে একটা বেকুব পেয়েছিস?
কেন মাজহার সাহেব? এই কথা বলছেন কেন?
তুই ছাড়া পেলে আর ফিরে আসবি? তুই শালা টিকটিকির বাচ্চা সোজা যাবি পুলিশের কাছে।
জি না মাজহার সাহেব। খোদার কসম যাব না। আপনার টাকা আমি বুঝায়ে দিব।
কাঁচকলা দিবি।
দিব মাজহার সাহেব। আল্লাহর কসম।
আচ্ছা যা–মনে করলাম তুই দিলি তাতে আমার লাভ কী? আমার পার্টির সাথে বেইমানি হল। সেই পার্টি আমারে ছেড়ে দিবে? আমারে আর কাজ দিবে?
কয়েস কোনো কথা বলল না।
তোরে মেরে আজ দুই হাজার টাকা পাব। সপ্তাহ দুই পরে আরেকটা কেস আসবে। আরো দুই আড়াই হাজার টাকা। মাসে দুই–তিনটা বান্ধা কেস। আমি তোর বিশ হাজার টাকার লোভে বান্ধা কাজ ফেলে দিব? আমারে তুই বেকুব পেয়েছিস?
মাজহার সাহেব আপনি চাইলে আপনাকে আমি চল্লিশ হাজার টাকা দিব। খোদার কসম।
চুপ কর শালা। কথা বলিস না। তুই শালা চল্লিশ হাজার কেন, চল্লিশ টাকার কেসও না।