নিচে দরজার কাছে বড় টেবিলে জেরিনকে বসে থাকতে দেখা গেল। আবিদ হাসানকে দেখে অবাক হয়ে বলল, আপনি?
হ্যাঁ।
কখন এলেন?
এসেছি দুপুরবেলা। ডক্টর আজহার নিয়ে এসেছেন।
ও। সবকিছু ঠিক আছে তো?
আবিদ হাসান জেরিন নামের মেয়েটির চোখের দিকে তাকালেন, সেখানে কোনো ধরনের জটিলতা নেই, সপ্রশ্ন চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ হাসান তাকে বিশ্বাস করবেন বলে ঠিক করলেন। বললেন, না, সবকিছু ঠিক নেই।
মেয়েটি চমকে উঠে বলল, কী হয়েছে?
আপনি যদি আমার সাথে আসেন আপনাকে বলতে পারি।
জেরিন ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলল, কিন্তু এখন আমার ডিউটি
আবিদ হাসান বাধা দিয়ে বললেন, আপনাকে আমি বলতে পারি আমি আপনাকে যে কথাটি বলব সেটি হবে আপনার জীবনের সবচেয়ে বড় ডিউটি।
জেরিন আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বলল, ঠিক আছে চলুন।
দুই মিনিট পর জেরিনের গাড়িতে বসে আবিদ হাসান বের হয়ে এলেন, গাড়িটি রমনা থানার দিকে যেতে থাকে।
০৬.
ডক্টর আজহারের এটাচি কেসে যে কাগজপত্র ছিল সেটি থেকে শেষ পর্যন্ত স্বরাষ্ট্র দপ্তরকে পেট ওয়ার্ল্ডের ষড়যন্ত্রের কথা বোঝানো সম্ভব হয়েছিল। প্রতিষ্ঠানটি বন্ধ করে দিতে আরো কয়েক মাস সময় লেগেছে। পুরো ব্যাপারটিতে অস্বাভাবিক গোপনীয়তা রাখা হয়েছে, খবরের কাগজে কিছু ছাপা হয় নি। তার সঠিক কারণটি আবিদ হাসানের জানা নেই, তাকে সরকারের একেবারে সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনুরোধ করা হয়েছিল, তিনি সেই অনুরোধ রক্ষা করেছিলেন।
ঠিক কী কারণে টুইটি হঠাৎ করে অদৃশ্য হয়ে গেল এবং কেন তাকে আর ফিরে পাওয়া যাবে না সেই ব্যাপারটি নীলা অবশ্য কিছুতেই বুঝতে পারল না। বড় মানুষেরা মাঝে মাঝে সম্পূর্ণ অযৌক্তিক এবং অর্থহীন কাজ করে বসে থাকে; এটাও সেরকম কিছু একটা কাজ এভাবেই সে ব্যাপারটি ব্যাখ্যা করল। মাঝে মাঝেই তার টুইটির জন্য খুব মন খারাপ হয়ে যেত।
আবিদ হাসান ব্যাপারটি প্রায় ভুলেই গিয়েছিলেন। বছর দুয়েক পর হঠাৎ করে আবার সেটি মনে পড়ল পত্রিকায় সার্কাসের বিজ্ঞাপন দেখে। সার্কাসের পশুপাখির নানা ধরনের খেলাধুলার মাঝে সবচেয়ে বড় আকর্ষণ বুদ্ধিমান কুকুরের কলাকৌশল। একটি গ্রেট ডেন কুকুর নাকি মানুষের মতো সংখ্যা যোগ–বিয়োগ করতে পারে।
আবিদ হাসান তার মেয়েকে নিয়ে সার্কাস দেখতে গিয়েছিলেন। সত্যি সত্যি বিশাল একটি গ্রেট ডেন কুকুর সংখ্যা যোগ–বিয়োগ করে দেখাল, ইংরেজি নির্দেশ পড়ে সেই নির্দেশ মোতাবেক কিছু কাজকর্ম করল। সার্কাস শেষ হলে আবিদ হাসান কুকুরটিকে দেখতে গিয়েছিলেন। বড় একটি লোহার খাঁচায় আটকে রাখা ছিল, আবিদ হাসানকে দেখে হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর খেপে গিয়ে সেটা খাঁচার মাঝে লাফ–ঝাঁপ দিতে শুরু করে। কুকুরের ট্রেইনার অবাক হয়ে বলল, কী আশ্চর্য! এটি খুব শান্ত কুকুর, আপনাকে দেখে এভাবে খেপে গেল কেন?
আমি জানি না।
আপনি কি কিছু বলেছেন? এই ব্যাটা আবার মানুষের কথা বুঝতে পারে।
হ্যাঁ। বলেছি।
কী বলেছেন?
বলেছি, কী খবর ডক্টর ট্রিপল-এ?
কথাটি একটি রসিকতা মনে করে ট্রেইনারটি হা হা করে হাসতে শুরু করল।
দ্বিতীয় জীবন
কয়েসের পিঠে একটা লাথি দিয়ে ছায়ামূর্তিটি বলল, ওঠ। শালা বেজন্মা কোথাকার। কয়েস উবু হয়ে অন্ধকার ঘরের কোনায় বসে ছিল। তার দুই হাত পিছনে শক্ত করে বাধা। কব্জিতে না বেঁধে কনুইয়ের কাছে বেঁধেছে। সস্তা নাইলনের দড়ি, চামড়া কেটে বসে যাচ্ছে। লাথি খেয়ে সে উঠে দাঁড়াতে চেষ্টা করল, মানুষের ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য হাত দুটোর খুব প্রয়োজন, হাত বাঁধা থাকায় সোজা হয়ে দাঁড়াতে গিয়ে সে হুমড়ি খেয়ে পড়ে যাচ্ছিল, কোনোমতে তাল সামলে সে সোজা হয়ে দাঁড়াল। পিছন থেকে তাকে একটা ধাক্কা দিয়ে ছায়ামূর্তিটি বলল, চল।
কয়েস শুকনো গলায় জিজ্ঞেস করল, কোথায়?
মানুষটি পিছন থেকে অত্যন্ত রূঢ় গলায় বলল, তোর শ্বশুরবাড়িতে হারামজাদা বাঞ্চত কোথাকার।
কয়েস কোনো কথা না বলে অন্ধকারে মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইল। পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি আবার একটা ধাক্কা দিতেই সে হাঁটতে শুরু করে। বাইরে নির্জন অন্ধকার রাত। হেমন্তের হালকা কুয়াশা চারদিকে এক ধরনের অস্পষ্ট আবরণের মতো ঝুলে আছে। কৃষ্ণপক্ষের রাত, অনেক দেরি করে চাঁদ উঠেছে, জ্যোৎস্নার নরম আলো চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েস চোখ তুলে তাকাল–দৃশ্যটি সম্ভবত সুন্দর কিন্তু সেটা সে বুঝতে পারছে না। সুন্দর জিনিস অনুভব করার জন্য যে রকম মানসিক প্রস্তুতির প্রয়োজন সেটি তার নেই।
কয়েস হাঁটতে হাঁটতে পিছনের মানুষটিকে বলল, আপনাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?
পিছনের মানুষটি খেঁকিয়ে উঠে বলল, চুপ কর শালা। কথা বলবি না।
মাত্র একটা কথা।
মানুষটি ধমক দিয়ে বলল, চুপ।
কয়েস চুপ করে শীতের হিম কুয়াশায় আরো কিছুক্ষণ হেঁটে যায়, তারপর প্রায় মরিয়া হয়ে আরো একবার কথা বলতে চেষ্টা করে, ভাই, আপনাকে শুধু একটা কথা জিজ্ঞেস করি? একটা কথা।
পিছনের মানুষটা কোনো কথা বলল না। কয়েস আবার অনুনয় করে বলল, করি?
কী কথা?
আমাকে কী করবেন?
পিছনের মানুষটা কোনো কথা না বলে হঠাৎ হা হা করে হেসে উঠল। কয়েস আবার জিজ্ঞেস করল, কী করবেন?