আবিদ হাসান বন্ধ দরজার দিকে তাকিয়ে থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন–তার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না কিছুক্ষণের মাঝেই তার মস্তিষ্ককে একটা বিশাল গ্রেট ডেনের মাথায় বসিয়ে দেওয়া হবে। এটি কি সত্যিই ঘটছে নাকি এটা একটা দুঃস্বপ্ন? ভয়ঙ্কর একটা দুঃস্বপ্ন?
আবিদ হাসান তার হাতের দিকে তাকালেন, দুই হাতে হাতকড়া দিয়ে প্লাটফর্মের সাথে আটকে রাখা, কংক্রিটের দেয়াল, উপরে এয়ার কুলারের ভেন্ট, স্টিলের দরজা উপরে ইলেকট্রনিক নিরাপত্তাসূচক নম্বর, একটু দূরে টুইটির কুঁকড়ে থাকা শরীর সবকিছু একটা ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো, কিন্তু সেটি দুঃস্বপ্ন নয়। আবিদ হাসান প্রাণপণ চেষ্টা করলেন নিজেকে শান্ত রাখার কিন্তু এবারে অনেক কষ্ট করেও নিজেকে শান্ত করতে পারলেন না। শুধু তার মনে হতে লাগল ভয়ঙ্কর একটা চিৎকার করে ধাতব প্লাটফর্মটিতে মাথা কুটতে শুরু করবেন।
কুকুরের একটি চাপা শব্দ শুনে আবিদ হাসান মাথা ঘুরিয়ে তাকালেন। টুইটি আবার উঠে বসেছে, দুই পায়ের মাঝখানে মাথা রেখে ভীত চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আবিদ হাসান হঠাৎ বিদ্যুৎস্পৃষ্টের মতো চমকে উঠলেন, টুইটি কি তাকে সাহায্য করতে পারবে না?
আবিদ হাসান সোজা হয়ে বসে টুইটিকে ডাকলেন, টুইটি।
টুইটি মাথা তুলে আবিদ হাসানের দিকে তাকাল। আবিদ হাসান চাপা গলায় বললেন, তুমি আমার কথা বুঝতে পারছ?
টুইটি কষ্ট করে তার মাথা নাড়ল, সে বুঝতে পারছে। আবিদ হাসান উত্তেজিত গলায় বললেন, তা হলে তুমি আমাকে সাহায্য কর। ঠিক আছে?
টুইটি ক্লান্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে মাথা নেড়ে আবিদ হাসানের দিকে তাকাল।
ভেরি গুড টুইটি। চমৎকার। তুমি টেবিলের উপর ওঠ। সেখান থেকে মুখে করে চাবিটা নিয়ে আসবে আমার কাছে। বুঝেছ?
টুইটি না–সূচকভাবে মাথা নাড়ল, সে ঠিক বুঝতে পারছে না। আবিদ হাসান একটু অধৈর্য হয়ে বললেন, না বুঝলেও ক্ষতি নেই, আমি তোমাকে সাহায্য করব। যাও তুমি টেবিলের উপর ওঠ।
টুইটি নিজেকে টেনে টেনে নিতে থাকে, প্রথমে চেয়ার তারপর সেখান থেকে কষ্ট করে টেবিলের উপর উঠল। আবিদ হাসান উত্তেজনা চেপে রেখে বললেন, এখন ডান দিকে যাও।
টুইটি অনিশ্চিতের মতো দাঁড়িয়ে রইল তারপর ডানদিকে এগিয়ে গেল। আবিদ হাসান বললেন, ঐ যে চকচকে জিনিসটা সেটা চাবি। মুখে তুলে নাও।
টুইটি একটা কলম মুখে তুলে নিল। আবিদ হাসান মাথা নেড়ে বললেন, না। না। এটা চাবি না, এটা কলম। চাবিটা আরো সামনে।
টুইটি কলমটা রেখে প্রথমে একটা পেন্সিল, তারপর একটা নোট বই এবং সবশেষে চাবিটা তুলে নিল। আবিদ হাসান চাপা আনন্দের স্বরে বললেন, ভেরি গুড টুইটি! ভেরি ভেরি গুড! এভাবে চাবিটা নিয়ে এস আমার কাছে।
টুইটি চাবিটা মুখে নিয়ে টেবিল থেকে নেমে আবিদ হাসানের কাছে এগিয়ে এল। আবিদ হাসান চাবিটা হাতে নিয়ে হাতকড়াটা খোলার চেষ্টা করলেন। কোথায় চাবি দিয়ে খুলতে হয় বুঝতে একটু সময় লাগল, একবার বুঝে নেবার পর খুট করে হাতকড়াটা খুলে যায়। উত্তেজনায় আবিদ হাসানের বুক ঠক ঠক করতে থাকে, সত্যি সত্যি তিনি এখান থেকে বেঁচে যেতে পারবেন কি না তিনি এখনো জানেন না, কিন্তু একবার যে শেষ চেষ্টা করে দেখবেন সে ব্যাপারে কোনো সন্দেহ নেই। আবিদ হাসান টুইটিকে বুকে চেপে ধরে একবার আদর করলেন, তারপর যেখানে শুয়ে ছিল সেখানে শুইয়ে রেখে বললেন, তুমি এখান থেকে নড়বে না। ঠিক আছে?
টুইটি মাথা নেড়ে আবার দুই পায়ের মাঝখানে মাথাটা রেখে চোখ বন্ধ করল। কুকুরটি মনে হয় আর বেশিক্ষণ বেঁচে থাকবে না।
আবিদ হাসান এবারে ঘরটা ঘুরে দেখলেন, একটা লোহার রড বা শক্ত কিছু খুঁজছিলেন, টেবিলের নিচে সেরকম একটা কিছু পেয়ে গেলেন। এটা দিয়ে জোরে মাথায় আঘাত করতে পারলে একজন মানুষকে ধরাশায়ী করা খুব কঠিন হবে না। আবিদ হাসান রডটা নিয়ে তার আগের জায়গায় ফিরে এলেন। হাতকড়াটা হাতের ওপর আলতো করে রেখে প্লাটফর্মের কাছে বসে রইলেন। ডক্টর আজহার ফিরে এলে একবারও সন্দেহ করতে পারবে না যে তিনি আসলে এখন নিজেকে মুক্ত করে রেখেছেন।
ডক্টর আজহার ফিরে এল বেশ অনেকক্ষণ পর। তার গলায় ঝুলানো কার্ডটি দিয়ে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকে বেশ সহৃদয় ভঙ্গিতে বলল, মিস্টার আবিদ হাসান, একটু দেরি হয়ে গেল। কেন জানেন?
আবিদ হাসান কোনো কথা বললেন না, ডক্টর আজহার সেটা নিয়ে কিছু মনে করল না, হাসি মুখে বলল, এই পেট ওয়ার্ল্ডে সব মিলিয়ে আমরা চার–পাঁচজন মানুষ প্রকৃত ব্যাপারটি জানি। অন্যেরা সবাই জানে এটি হান্ড্রেড পার্সেন্ট খাঁটি বিজনেস! কাজেই যখনি বেআইনি কিছু করতে হয় পুরো দায়িত্বটি এসে পড়ে আমাদের ওপর! আমি ছাড়া অন্য সবাই আসলে সিকিউরিটির মানুষ নতুবা যন্ত্র! কাজেই সবকিছুই আমাকে করতে হয়। বুঝেছেন?
ডক্টর আজহার টেবিলে একটা কাঁচের এম্পুল রেখে সেখানে একটা সিরিঞ্জ দিয়ে ওষুধ টেনে নিতে নিতে বলল, আপনাকে একটা ঘুমের ওষুধ দিয়ে অজ্ঞান করে নিতে হবে, তারপর ঐ কনভেয়ার বেল্টে আপনাকে উপুড় করে শুইয়ে দিতে হবে। ব্যস, তারপর আমার দায়িত্ব শেষ। কাল সকালে আপনি যখন ঘুম থেকে উঠবেন আপনি আবিষ্কার করবেন যে আপনি একটা বিশাল কুকুরের দেহে আটকা পড়ে আছেন। ডক্টর আজহার আনন্দে হা হা করে হেসে উঠল।