আবিদ হাসান শিউরে উঠলেন। কোনোমতে একটা নিশ্বাস বুক থেকে বের করে দিয়ে বললেন, আপনাদের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলো ভাঁওতাবাজি।
বলতে পারেন। আমরা অবশ্য ছোটখাটো মেডিক্যাল হেল্প দিই। যখন একটা বাচ্চার ভ্রূণ দরকার হয় কোনো একটা প্রেগন্যান্ট মহিলা থেকে নিয়ে নিই। তারা অবশ্য জানে না, তাদেরকে বলা হয় কোনো কারণে মিসক্যারেজ হয়েছে। আমাদের ডাক্তারেরা মাদের উল্টো বকাবকি করে অনিয়ম করার জন্য। ডক্টর আজহার কথা শেষ করে হা হা করে হাসতে শুরু করল।
আবিদ হাসান স্থির চোখে ডক্টর আজহারের চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, আপনার ভিতরে এ নিয়ে কখনো কোনো অপরাধবোধ জন্মায় না?
অপরাধবোধ? ডক্টর আজহার আবার শব্দ করে হেসে উঠল, নাগাসাকি আর। হিরোশিমাতে যারা নিউক্লিয়ার বোমা ফেলেছিল তাদের কি অপরাধবোধ হয়েছিল? আলেকজান্ডার দি গ্রেটের কি অপরাধবোধ হয়েছিল? হয় নি। হওয়ার কথা নয়। একটা বড় কিছু করার জন্য অনেক ছোট ত্যাগ করতে হয়। এই দেশকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার জন্য আমাদের দেশের কিছু মানুষের এই ত্যাগ স্বীকার করতে হবে। একদিন যখন আমাদের এই প্রজেক্ট দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করে দেবে।
আবিদ হাসান বাধা দিয়ে বললেন, যথেষ্ট হয়েছে। আমি আর শুনতে চাই না।
ডক্টর আজহার প্রথমবার একটু রেগে উঠল, বলল, কেন শুনতে চান না?
কারণ উন্মাদের প্রলাপ অন্য উন্মাদেরা শুনুক। আমার শোনার প্রয়োজন নেই।
ডক্টর আজহার খানিকক্ষণ স্থির দৃষ্টিতে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা এগিয়ে এনে কঠিন গলায় বলল, আমাদের এই প্রজেক্টে কত ডলার ইনভেস্ট করা হয়েছে আপনি জানেন?
না। আমার জানার প্রয়োজন নেই। ইচ্ছে নেই।
তবু আপনাকে শুনতে হবে। সাড়ে তিন বিলিয়ন ডলার। আপনি জানেন বিলিয়ন ডলার মানে কত? এক হাজার মিলিয়ন হচ্ছে এক বিলিয়ন। আর মিলিয়ন কত জানেন? এক হাজার–_
আমার জানার প্রয়োজন নেই।
আছে। কেন আছে জানেন?
কেন?
কারণ সারা পৃথিবীর মাঝে শুধু আপনাকে আমি এই তথ্য দিতে পারি। একটি প্রাণীর দেহে অন্য প্রাণীর টিস্যুকে বাঁচিয়ে রাখার টেকনিক আমরা দাঁড়া করিয়েছি। এন্টি রিজেকশান ড্রাগের পেটেন্ট আমাদের। এখানে ব্রেন–ট্রান্সপ্লান্টের অপারেশন করে রোবট সার্জন। সেই রোবট সার্জন দাঁড়া করতে আমাদের কত খরচ হয়েছে জানেন? সেই সফটওয়্যার দাঁড়া করতে আমাদের কত দিন লেগেছে জানেন?
আবিদ হাসান মাথা নেড়ে বললেন, আমি জানতে চাই না।
ডক্টর আজহার চেয়ার থেকে উঠে দাঁড়িয়ে চিৎকার করে বলল, জানতে হবে। কারণ শুধু আপনিই এটা জানতে পারবেন। শুধু আপনাকেই আমি বলতে পারব।
আবিদ হাসান প্রথমবার এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করলেন, কেন শুধুমাত্র তাকে বলতে পারবে সেটি অনুমান করা খুব কঠিন নয়। কাঁপা গলায় জিজ্ঞেস করলেন, আমাকে মেরে ফেলা হবে বলে?
না। আমি অপচয় বিশ্বাস করি না। শুধু শুধু আপনাকে মেরে কী হবে?
তা হলে?
আপনাকে আমরা ব্যবহার করব।
ব্যবহার?
হ্যাঁ। আমাদের কাছে বিশাল একটা কুকুর এসেছে। গ্রেট ডেন। চমৎকার কুকুর, তার মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করব আপনার মস্তিষ্ক দিয়ে। আপনার বিশাল মস্তিষ্কের পুরোটা নিতে পারব না– যেটুকু পারি সেটুকু নেব। ডক্টর আজহার মুখে হাসি ফুটিয়ে বলল, আইডিয়াটি কেমন?
আবিদ হাসান অবিশ্বাসের দৃষ্টিতে ডক্টর আজহারের দিকে তাকিয়ে রইল, ডক্টর আজহার মাথা নেড়ে বলল, আপনার এত চমৎকার একটি মস্তিষ্ক সেটা অপচয় করা কি ঠিক হবে? কী বলেন?
আবিদ হাসান দাতে দাঁত ঘষে বললেন, তুমি জাহান্নামে যাও–দানব কোথাকার।
ডক্টর আজহার জিভ দিয়ে চুক চুক শব্দ করে বলল, রাগ হচ্ছেন কেন মিস্টার আবিদ হাসান? আমি পরীক্ষা করে দেখতে চাই, আপনার স্মৃতির কতটুকু অবশিষ্ট থাকে।
আবিদ হাসান চিৎকার করে কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল ঠিক তখন টুইটি একটা চাপা শব্দ করল, সামনের দুই পায়ের মাঝে মাথা চেপে রেখে থরথর করতে লাগল। দেখে মনে হল সারা শরীরে এক ধরনের খিচুনি শুরু হয়েছে। ডক্টর আজহার টুইটির কাছে এগিয়ে গেল, চোখের পাতা টেনে কিছু একটা দেখে মাথা নেড়ে উঠে দাঁড়াল, খানিকটা হতাশ ভঙ্গিতে বলল, এখনো হল না। কুকুরটা তার মস্তিষ্ককে রিজেক্ট করতে শুরু করেছে। আমাদের এন্টি–রিজেকশান ড্রাগকে আরো নিখুঁত করতে হবে।
ডক্টর আজহার পা দিয়ে টুইটিকে উল্টে দিয়ে লম্বা পা ফেলে টেবিলটার কাছে এগিয়ে এল। পকেট থেকে কাগজপত্র এবং চাবি টেবিলের ওপর রেখে অনেকটা আপন মনে বলল, আপনি মন খারাপ করবেন না মিস্টার আবিদ হাসান। ঘুমের একটা ইনজেকশন দিয়ে দেব, আপনি কিছু বুঝতেও পারবেন না। আপনার ঘুমন্ত দেহ ট্রেতে তুলে দেব, ব্যস আমাদের আর কোনো দায়িত্ব নেই।
আবিদ হাসান কোনো কথা বললেন না, হিংস্র চোখে ডক্টর আজহারের দিকে তাকিয়ে রইলেন। ডক্টর আজহার ঘর থেকে বের হতে গিয়ে আবার দাঁড়িয়ে গিয়ে বলল, একটা জিনিস লক্ষ্য করেছেন? আপনার সাথে কিন্তু আমার বেশ মিল রয়েছে। আমার প্রায় সমবয়সী, দেখতেও অনেকটা একরকম। আমাদের বুদ্ধিমত্তাও মনে হয় কাছাকাছি। কিন্তু আপনার ক্ষমতা আমার ধারে কাছে নয়। আপনি চিন্তাও করতে পারবেন না টাকা দিয়ে কত কী করা যায়।
ডক্টর আজহার তার গলায় ঝোলানো কার্ড দিয়ে দরজা খুলে ঘর থেকে বের হয়ে গেল।