থানার সামনে টুইটিকে নিয়ে নেমে আবিদ হাসান স্কুটারের ভাড়া মিটিয়ে দিলেন। তার হাতে কুকুরটি দেখে কয়েকজন পথচারী কৌতূহল নিয়ে তাকাল, একজন বলল, কী সুন্দর কুকুর!
হ্যাঁ। আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, খুব সুন্দর।
বিদেশী কুকুর নাকি?
হ্যাঁ। এটার নাম আইরিশ টেরিয়ার।
একটু হাত দিয়ে দেখি? কামড় দেবে না তো?
না কামড় দেবে না। খুব শান্ত কুকুর।
মানুষটি টুইটির মাথায় হাত বুলানোর জন্য এগিয়ে এল। ঠিক তখন আবিদ হাসান তার পিঠে একটা শক্ত ধাতব স্পর্শ অনুভব করলেন। শুনতে পেলেন কেউ তার কানের কাছে মুখ রেখে ফিসফিস করে ইংরেজিতে বলছে, আমি একজন পেশাদার খুনি। তুমি একটু নড়লেই খুন হয়ে যাবে।
আবিদ হাসান হতচকিত হয়ে দাঁড়িয়ে গেলেন। মানুষটি আরো কাছে এসে বলল, তোমার আর কোনো কিছু করার সুযোগ নেই, আমার কথা বিশ্বাস না করলে চেষ্টা করে দেখতে পার।
আবিদ হাসান চেষ্টা করলেন না। যে মানুষটি টুইটির মাথায় হাত বুলিয়েছে সে কিছু একটা বলছে কিন্তু তিনি এখন কিছু বুঝতে পারছেন না। তার কানের কাছে মুখ রেখে মানুষটি ফিসফিস করে বলল, আমি মনে মনে দশ পর্যন্ত গুনব, তার মাঝে তুমি সামনের। গাড়িটাতে ওঠ। তুমি ইচ্ছা করলে নাও উঠতে পার–সত্যি কথা বলতে কী, আমি চাই তুমি না ওঠ। তা হলে তোমাকে আমি খুন করতে পারি। আমার জন্য সেটা খুব কম ঝামেলার।
আবিদ হাসান নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়িয়ে রইলেন। শুনতে পেলেন টুইটি একটা চাপা। শব্দ করল। যে মানুষটি কুকুরের মাথায় হাত বুলিয়েছে সে বিদায় নিয়ে চলে যাচ্ছে। আরো দু–একজন মানুষ সুন্দর কুকুরটি দেখার জন্য ভিড় জমিয়েছে। তার মাঝে পিছনের মানুষটি হাতের অস্ত্রটি দিয়ে আবিদ হাসানকে একটা ধাক্কা দিয়ে ফিসফিস করে বলল, আমি যেখানে রিভলবারটি ধরেছি সেখানে তোমার হৃৎপিণ্ড। কাজেই কী করবে ঠিক করে নাও।
আবিদ হাসানের হাত কাঁপতে থাকে, মনে হতে থাকে তিনি হাঁটু ভেঙে পড়ে যাবেন। কিন্তু তিনি পড়ে গেলেন না। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন। মানুষটার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখার ইচ্ছেটাকে অনেক কষ্টে আটকে রেখে জিজ্ঞেস করলেন, তোমার দেশ কোথায়?
পিছনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটি দীর্ঘশ্বাসের মতো একটা শব্দ করে বলল, সামাজিক কথাবার্তা বলার জন্য তুমি সময়টা ভালো বেছে নাও নি। আমি গুনতে শুরু করছি। এক।
আবিদ হাসানের মস্তিষ্ক হঠাৎ করে শীতল হয়ে আসে, পুরো পরিস্থিতিটুকু হঠাৎ করে তার কাছে স্পষ্ট হয়ে এল। পিছনের মানুষটির ইংরেজি উচ্চারণ যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণাঞ্চলের। মানুষটি পেশাদার খুনি এবং সম্ভবত তাকে এখনই মেরে ফেলবে। আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন এই মানুষটির কথা শোনা ছাড়া তার আর কিছুই করার নেই। তিনি একটা নিশ্বাস ফেললেন এবং পাঁচ পর্যন্ত গোনার আগেই টুইটিকে নিয়ে হেঁটে হেঁটে গাড়িতে উঠে বসলেন। পিছনের মানুষটি হেঁটে হেঁটে তার পাশে এসে বসল, আবিদ হাসান কৌতূহল নিয়ে মানুষটার দিকে তাকালেন। মানুষটি সুদর্শন, বাঙালির মতো হলেও বাঙালি নয়, মানুষটি সম্ভবত মেক্সিকান।
ড্রাইভার গাড়িটা ছেড়ে দিল। পাশে বসে থাকা মেক্সিকান মানুষটি একটি বড় রিভলবার তার কোলের উপর রেখে হাত বাড়িয়ে টুইটির মাথায় হাত বুলিয়ে ইংরেজিতে বলল, এই কুকুরের জন্য আমাকে মানুষ মারতে হবে–এই কথাটা কে বিশ্বাস করবে বল?
আবিদ হাসান মনে মনে বললেন, কেউ না।
০৫.
ডক্টর আজহার নরম গলায় বলল, আমি খুবই দুঃখিত মিস্টার আবিদ হাসান আপনাকে এভাবে কষ্ট দেওয়ার জন্য।
আবিদ হাসান স্থির চোখে ডক্টর আজহারের দিকে তাকালেন, লোকটির গলার স্বরে এক ধরনের আন্তরিকতা রয়েছে, অন্য যে কোনো সময় হলে তিনি হয়তো লোকটার কথা বিশ্বাস করতেন, কিন্তু এখন বিশ্বাস করার কোনো উপায় নেই। দুপুরবেলা দুজন মানুষ তাকে স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র দিয়ে খুন করার চেষ্টা করেছে, রমনা থানার সামনে থেকে একজন মেক্সিকান পেশাদার খুনি তাকে ধরে এনেছে। এই মুহূর্তে একটা লোহার প্ল্যাটফর্মের দুইপাশে তার দুই হাত রেখে হাতকড়া পরিয়ে দিয়েছে। আবিদ হাসান মেঝেতে হাঁটু গেড়ে বসে আছেন, দুই হাত আটকে থাকায় নড়াচড়া করতে পারছেন না। ভয় বা আতঙ্ক নয়, আবিদ হাসান নিজের ভিতরে এক ধরনের তীব্র অপমানবোধ অনুভব করছেন।
ডক্টর আজহার টেবিলের পাশে একটা গদিআঁটা চেয়ারে বসে পা দুলিয়ে বলল, আমার হিসাবে একটা ভুল হয়ে গেছে। আপনাকে আমি আন্ডার এস্টিমেট করেছি। আপনার বুদ্ধিমত্তা সাধারণ মানুষ থেকে অনেক বেশি। এখন আপনাকে বলতে আমার কোনো দ্বিধা নেই, পেট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে আপনার প্রত্যেকটা ধারণা সত্যি।
ডক্টর আজহার মাথা ঘুরিয়ে টুইটির দিকে তাকাল, ঘরের এক কোনায় সেটি শান্ত হয়ে বসে আছে। তার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, আপনি ঠিকই অনুমান করছেন, এই যে কুকুরটা দেখছেন এটি আসলে একটি মানুষ। কুকুরের শরীরে আটকে পড়ে থাকা মানুষ।
আবিদ হাসান ভেবেছিলেন কোনো কথা বলবেন না কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের কাছে হার মানলেন, মাথা তুলে জিজ্ঞেস করলেন, একটা কুকুরের মস্তিষ্কের সাইজ টেনিস বলের মতো। মানুষের মস্তিষ্ক তো অনেক বড়।
হ্যাঁ। ডক্টর আজহার মাথা নাড়ল। বলল, সে জন্য আমরা মস্তিষ্ক ট্রান্সপ্লান্ট করি ফিটাস থেকে, ভ্রূণ থেকে।