প্রথমেই তিনি দেখলেন তার পকেটে মানিব্যাগ এবং সেই মানিব্যাগে কোনো টাকা আছে কি না। তারপর একটু হেঁটে প্রথমেই যে স্কুটার পেলেন সেটাকে থামিয়ে জিজ্ঞেস করলেন সেটি মতিঝিল যাবে কি না। স্কুটারটি রাজি হওয়া মাত্র তিনি সেটাতে উঠে বসে গেলেন। স্কুটারটি ছুটে চলতেই আবিদ হাসান পিছনে তাকিয়ে দেখার চেষ্টা করলেন কেউ তাকে অনুসরণ করছে কি না, যখন নিঃসন্দেহ হলেন কেউ তার পিছু পিছু আসছে না তখন তিনি স্কুটারটি থামিয়ে নেমে পড়লেন। ভাড়া চুকিয়ে তিনি ফুটপাত ধরে হাঁটতে হাঁটতে একটা ফোন–ফ্যাক্সের দোকান খুঁজে বের করলেন। ভিতরে মধ্যবয়স্ক একজন মানুষ একটা ফোন সামনে নিয়ে উদাস হয়ে বসে ছিল, তাকে দেখে সোজা হয়ে বসল। আবিদ হাসান তার স্ত্রীর টেলিফোন নম্বরটি দিলেন, ডায়াল করে মানুষটি টেলিফোনটি আবিদ হাসানের দিকে এগিয়ে দেয়। অন্যপাশে তার স্ত্রীর গলার আওয়াজ পেয়ে আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, মুনিরা–
হ্যাঁ, আবিদ। কী ব্যাপার?
কী ব্যাপার তুমি এখন জানতে চেয়ো না। আমি তোমাকে যা বলব তাই তোমাকে করতে হবে। বুঝেছ?
আবিদ হাসানের গলার স্বরে এমন একটা কিছু ছিল যে মুনিরা শঙ্কিত হয়ে উঠলেন। ভয়–পাওয়া গলায় বললেন, কী হয়েছে?
অনেক কিছু। তোমাকে পরে বলব। তোমাকে এই মুহূর্তে নীলাকে স্কুল থেকে নিয়ে আসতে হবে। কিন্তু তুমি নিজে যেতে পারবে না। বুঝেছ?
বুঝেছি। কিন্তু নিজে যেতে পারব না কেন?
আবিদ হাসান শান্ত গলায় বললেন, তোমাকে পরে বলব। নীলাকে স্কুল থেকে এনে তোমরা দুজন হোটেল সোনারগাঁওয়ে চলে যাবে। সেখানে একটা রুম ভাড়া করবে। রুম ভাড়া করবে জাহানারা বেগমের নামে–
জাহানারা বেগম? জাহানারা বেগম কে?
আমার মা। তুমি জান।
হ্যা সেটা তো জানি, কিন্তু তার নামে কেন?
তা হলে আমার নামটা মনে থাকবে, তোমার সাথে আমি যোগাযোগ করতে পারব। সেজন্যে
মুনিরা হাসান কাঁপা গলায় বললেন, কী হচ্ছে আবিদ? আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি। আমাকে তুমি ভয় দেখাচ্ছ কেন?
আমি তোমাকে সব বলব। শুধু জেনে রাখ আমি তোমাকে মিছিমিছি ভয় দেখাচ্ছি না। শুনে রাখ, তুমি কিছুতেই নীলাকে নিয়ে বাসায় যাবে না। কিছুতেই যাবে না। মনে থাকবে?
থাকবে।
হোটেল থেকে তোমরা বাইরে কাউকে ফোন করবে না। বুঝেছ?
বুঝেছি।
তোমার কাছে টাকা না থাকলে টাকা ম্যানেজ করে নাও। আর এই মুহূর্তে নীলাকে আনার ব্যবস্থা কর।
মুনিরা হাসান টেলিফোনে হঠাৎ ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলেন। ভাঙা গলায় বললেন, তুমি কোথা থেকে কথা বলছ?
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেলে বললেন, সেটা তোমার শুনে কাজ নেই। যখন। সময় হবে জানাব। আমি রাখছি। জেনে রাখ আমি ভালো আছি।
মুনিরা আরো কিছু একটা বলতে চাচ্ছিলেন কিন্তু আবিদ হাসান তার আগেই টেলিফোনটা রেখে দিলেন, তার হাতে সময় খুব বেশি নেই। টেলিফোনের বিল দিয়ে আবিদ হাসান বের হয়ে এলেন। তাকে যে পেট ওয়ার্ল্ডের লোকেরা মেরে ফেলতে চেয়েছে সে ব্যাপারে তার কোনো সন্দেহ নেই। যার অর্থ টুইটির ব্যাপারে তার ধারণাটি সত্যি। টুইটি সাধারণ কোনো কুকুর নয়, এর মস্তিস্কটি মানুষের মস্তিষ্ক দিয়ে পাল্টে দেওয়া হয়েছে। মানুষের মস্তিষ্কের আকার অনেক বড়, কুকুরের মাথায় সেটি আটানো সম্ভব নয়, কাজেই সম্ভবত পুরোটুকু নেওয়া হয় না। কিংবা কে জানে হয়তো মস্তিষ্কের টিস্যু লাগিয়ে দেওয়া হয়, যেন কুকুরটির মাঝে খানিকটা কুকুর এবং খানিকটা মানুষের বুদ্ধিমত্তা চলে আসে। আবিদ হাসানের হঠাৎ করে পেট ওয়ার্ল্ডের সেবা প্রতিষ্ঠানগুলোর কথা মনে পড়ল। কে জানে হয়তো সেখানে সেবা দেওয়ার নাম করে হতদরিদ্র মহিলাদের সন্তানদের নিয়ে নেওয়া হয়। পুরো ব্যাপারটাই একটি ভয়ঙ্কর ষড়যন্ত্র। এই ষড়যন্ত্রের কথা প্রকাশ করার পুরো দায়িত্বটিই এখন আবিদ হাসানের–সেটি প্রকাশ করতে হলে সবচেয়ে প্রথম দরকার টুইটিকে। সবচেয়ে বড় প্রমাণই হচ্ছে টুইটি। কাজেই এখন তার টুইটিকে উদ্ধার করতে হবে। হাতে সময় নেই, টুইটিকে নিয়ে আসার জন্য যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার বাসায় ফিরে যেতে হবে।
আবিদ হাসান রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে একটা খালি স্কুটারকে থামালেন। স্কুটারে করে তিনি তার বাসার সামনে দিয়ে গিয়ে আবার ঘুরে এলেন। আশপাশে সন্দেহজনক কেউ দাঁড়িয়ে নেই। বাসার পিছনে একটি গেট রয়েছে যেটি কখনোই ব্যবহার হয় না, আবিদ হাসান তার কাছাকাছি এসে স্কুটার থেকে নেমে পড়লেন। স্কুটারটিকে দাঁড়া করিয়ে রেখে তিনি নেমে এলেন, পকেট থেকে চাবি বের করে তালা খুলে ভিতরে ঢুকে তিনি চাপা গলায় ডাকলেন, টুইটি।
প্রায় সাথে সাথেই টুইটি গাছের আড়াল থেকে তার কাছে ছুটে এসে তাকে ঘিরে আনন্দে লাফাতে শুরু করল। আবিদ হাসান দুই হাতে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে নিচু গলায় বললেন, টুইটি সোনা, চল এখান থেকে পালাই, এখন আমাদের খুব বিপদ।
টুইটি কী বুঝল কে জানে কয়েকবার মাথা নেড়ে একটা চাপা শব্দ করল। স্কুটারে উঠে আবিদ হাসান বললেন, রমনা থানায় চল।
স্কুটার চলতে শুরু করতেই আবিদ হাসান চারদিকে তাকাতে লাগলেন, কেউ তার পিছু পিছু আসছে কি না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। চারপাশে অসংখ্য গাড়ি রিকশা। স্কুটার ছুটে চলছে, তার মাঝে সন্দেহজনক কিছু চোখে পড়ল না। আবিদ হাসান একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললেন, কোনোভাবে থানার মাঝে ঢুকে পড়তে পারলেই নিশ্চিন্ত হওয়া যায়।