ডক্টর আজহার শীতল গলায় বলল, আপনি আমার কোন কথাটা বিশ্বাস করতে পারছেন না?
আমার ধারণা, আপনারা আসলে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে বুদ্ধিমান কুকুর তৈরি করেন নি। আপনারা খুব সাধারণ একটা কুকুরের মাথায়
কুকুরের মাথায়?
সাধারণ একটা কুকুরের মাথায় মানুষের মস্তিষ্ক লাগিয়ে দিয়েছেন। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিঙে আপনার কোনো দক্ষতা নেই–কিন্তু এ ব্যাপারে আপনার দক্ষতা আছে।
ডক্টর আজহার কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে হঠাৎ উচ্চৈঃস্বরে হাসতে শুরু করল, আবিদ হাসান টেলিফোনটা রেখে দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন।
দুপুরবেলা একটা খুব জরুরি মিটিং ছিল কিন্তু আবিদ হাসান দুপুরের আগেই বের হয়ে এলেন। মিটিঙে তাকে না দেখে তার প্রজেক্টের সবাই চেঁচামেচি শুরু করবে কিন্তু তার কিছু করার নেই। পেট ওয়ার্ল্ড সম্পর্কে তার ভিতরে যে সন্দেহটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠেছে সে ব্যাপারে নিঃসন্দেহ হওয়া দরকার। টুইটিকে নিয়ে তার মাথার এক্স–রে করিয়ে নিতে হবে। তাকে মাঝে মাঝেই নানারকম ওষুধ খাওয়ানো হয় সেগুলো ঠিক কী ধরনের ওষুধ সেটাও বিশ্লেষণ করতে হবে। টুইটির মস্তিষ্কের খানিকটা টিস্যু কোনোভাবে বের করা যায় কি না সেটা নিয়েও তার পরিচিত একজন নিউরো সার্জনের সাথে কথা বলতে হবে। পেট ওয়ার্ল্ডকে যদি আইনের আওতায় আনতে হয় তা হলে পুলিশকেও জানাতে হবে। এ দেশের পুলিশ তার কোনো কথা বিশ্বাস করবে কি না সে ব্যাপারে অবশ্য যথেষ্ট সন্দেহ আছে।
আবিদ হাসান পার্কিং লট থেকে তার গাড়িটা বের করে রাস্তায় ওঠার সময় রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা মাইক্রোবাস তার পিছু পিছু যেতে শুরু করল, সেটা তিনি দেখতে পেলেন। দেখতে পেলেও সেটি যে তার পিছু নিয়েছে সেটাও বোঝার তার কোনো উপায় ছিল না।
সেগুন বাগানে আবিদ হাসানের বাসার রাস্তাটুকু তুলনামূলকভাবে নির্জন, সেখানে ঢোকার পর হঠাৎ করে আবিদ হাসানের মনে পিছনের মাইক্রোবাসটি নিয়ে একটু সন্দেহ হল, রিয়ার ভিউ মিররে অনেকক্ষণ থেকে সেটাকে তিনি তার পিছনে দেখতে পাচ্ছিলেন। ঢাকার রাস্তায় একই গাড়ি প্রায় আধঘণ্টা সময় ঠিক পিছনে পিছনে আসার সম্ভাবনা খুব কম। পিছনের মাইক্রোবাসটি কাঁদের এবং ঠিক কেন তার পিছু পিছু আসছে সে সম্পর্কে আবিদ হাসানের কোনো ধারণাই ছিল না। এটি সত্যি সত্যি তার পিছু আসছে নাকি ঘটনাক্রমে তার পিছনে রয়েছে সেটা পরীক্ষা করার জন্য আবিদ হাসান একটা সুযোগের অপেক্ষায় রইলেন, খানিকদূর গিয়ে যখন দেখতে পেলেন সামনে কোনো গাড়ি নেই তখন একেবারে হঠাৎ করে তিনি গাড়িটি রাস্তার মাঝখানে ঘুরিয়ে নিয়ে উল্টোদিকে যেতে শুরু করলেন। খানিকদূর গিয়ে পিছনে তাকিয়ে দেখলেন মাইক্রোবাসটিও রাস্তার মাঝে ইউ–টার্ন নেওয়ার চেষ্টা করছে– সেটি যে তার পিছু পিছু আসছে সে ব্যাপারে এবারে তার কোনো সন্দেহ রইল না। আবিদ হাসান ঠিক কী করবেন বুঝতে পারলেন না। দ্রুত গাড়ি চালিয়ে সরে যাওয়ার সম্ভাবনা কম, সামনে বড় রাস্তায় অনেক ভিড়, রিয়ার ভিউ মিররে তাকিয়ে অবস্থাটা আঁচ করার চেষ্টা করছিলেন তার আগেই হঠাৎ করে মাইক্রোবাসটা গুলির মতো ছুটে এসে তাকে ওভারটেক করে রাস্তার মাঝে আড়াআড়িভাবে দাঁড়িয়ে গেল। আবিদ হাসান ব্রেক কষে গাড়ি থামালেন, তিনি অবাক হয়ে দেখলেন মাইক্রোবাস থেকে কালো পোশাক পরা দুজন মানুষ নেমে এসেছে, দুজনের হাতেই স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র।
আবিদ হাসানের সমস্ত শরীর আতঙ্কে অবশ হয়ে গেল, তার মাঝে কোনো একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় তাকে সচল রাখার চেষ্টা করে। কোনো কিছু না বুঝে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার সহজাত এবং আদিম প্রবৃত্তির তাড়নায় তিনি গাড়ি ব্যাক গিয়ারে নিয়ে এক্সেলেটরে সমস্ত শক্তি দিয়ে চাপ দিলেন। টায়ার পোড়া গন্ধ ছুটিয়ে গাড়িটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে পিছনে ছুটে গেল, কোথাও ধাক্কা লেগে প্রচণ্ড শব্দ করে কিছু একটা ভেঙেচুরে গুঁড়ো করে ফেলল, জিনিসটি কী আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন না এবং বোঝার চেষ্টাও করলেন না।
ঠিক এ রকম সময়ে মানুষ দুজন স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র হাতে তার দিকে লক্ষ্য করে গুলি করতে শুরু করে, আবিদ হাসান মাথা নিচু করে আবার এক্সেলেটরে চাপ দিতেই গাড়িটি জীবন্ত প্রাণীর মতো পিছনে ছিটকে গেল। ঝনঝন শব্দ করে গাড়ির কাঁচ ভেঙে পড়ল এবং তার মাথার উপর দিয়ে শিস দেওয়ার মতো শব্দ করে বুলেট ছুটে গেল। আবিদ হাসান সম্পূর্ণ আন্দাজের ওপর ভর করে গাড়িটা ঘুরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করলেন। বৃষ্টির মতো গুলি ছুটে এল, গাড়ির বনেটে প্রবল ধাতব শব্দ শোনা যেতে থাকে এবং সেই অবস্থায় গাড়িটা পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণহীনভাবে ঘুরে যায়, পাগলের মতো স্টিয়ারিং ঘুরিয়ে কোনোমতে গাড়িটার নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেতে চেষ্টা করলেন আবিদ হাসান। পুরোপুরি আন্দাজের ওপর নির্ভর করে গাড়িটা রাস্তায় তোলার চেষ্টা করলেন, আবার কোথাও ধাক্কা লেগে গাড়িটা লাফিয়ে কয়েক ফুট উপরে উঠে গেল। প্রচণ্ড শব্দে সেটা নিচে আছড়ে পড়ল এবং আবিদ হাসান তখন একটা বিস্ফোরণের শব্দ শুনলেন। গাড়িটাকে নিয়ন্ত্রণে আনার চেষ্টা করতে করতে মাথা তুলে পিছনে তাকিয়ে দেখতে পেলেন কালো পোশাক পরা মানুষ দুজন নিজেদের মাইক্রোবাসের দিকে ছুটে যাচ্ছে, গুলির শব্দ শুনে লোকজন ছোটাছুটি করে পালিয়ে যাচ্ছে। আবিদ হাসান বুক থেকে আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে গাড়িতে সোজা হয়ে বসে রাস্তায় নেমে এলেন। গাড়িটা চালাতে গিয়ে আবিষ্কার করলেন সেটি নড়তে চাইছে না, শব্দ শুনে বোঝা যাচ্ছে পিছনে কোনো একটি চাকার বাতাস বের হয়ে গেছে। সেই অবস্থায় গাড়িটাকে আবিদ। হাসান আরো কিলোমিটার খানেক চালিয়ে নিয়ে রাস্তার পাশে থামালেন। ঘটনাস্থলে লোকজনের মাঝে ছোটাছুটি হইচই হচ্ছিল, এখানে কেউ কিছু জানে না। তার ক্ষতবিক্ষত ভেঙেচুরে যাওয়া গাড়িটাও কারো দৃষ্টি আকর্ষণ করল না। ইঞ্জিন বন্ধ করে আবিদ হাসান নিজের দিকে তাকালেন, কপালের কাছে কোথাও কেটে গিয়ে রক্ত বের হচ্ছে, ডান হাতের কনুইয়ে প্রচণ্ড ব্যথা, তিনি হাতটা সাবধানে এক–দুইবার নেড়ে দেখলেন, কোথাও ভাঙে নি। পকেট থেকে রুমাল বের করে কপালের রক্তটা মুছে সাবধানে গাড়ি থেকে বের হলেন–তার অনেক সুখের গাড়ি একেবারে ভেঙেচুরে শেষ হয়ে গেছে। অসংখ্য গুলিতে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে, এটি একটি বিস্ময়ের ব্যাপার যে তার শরীরে গুলি লাগে নি। দীর্ঘদিন যুক্তরাষ্ট্রে ছিলেন বলে গাড়িতে উঠলেই সিটবেল্ট বাধার অভ্যাস হয়ে গিয়েছিল তাই কোনো গুরুতর জখম হয় নি। আবিদ হাসান গাড়ির দরজা বন্ধ করার সময় লক্ষ করলেন তার হাত। অল্প অল্প কাঁপছে। কিন্তু সাথে সাথে তিনি আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করলেন হঠাৎ করে তার মস্তিষ্ক আশ্চর্য রকম শীতল হয়ে গেছে তার ভিতরে কোনো উত্তেজনা নেই। কী করতে হবে সে সম্পর্কে তার খুব স্পষ্ট ধারণা আছে। এ