পৃথিবী কি দেখা যাচ্ছে?
হ্যাঁ এই দেখ– বলে কীশ কোথায় একটা সুইচ স্পর্শ করতেই হঠাৎ করে সামনে বিশাল একটা স্ক্রিনে পৃথিবীর ছবি ভেসে আসে। নীল গ্রহটির ওপর সাদা মেঘ, গ্রহটি ঘিরে খুব সূক্ষ্ম একটি নীলাভ আবরণ, পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের চিহ্ন।
য়ুল কিছুক্ষণ মুগ্ধ হয়ে পৃথিবীর দিকে তাকিয়ে থাকে, বুকের ভিতর আটকে থাকা একটা নিশ্বাস বের করে দিয়ে বলল, কী সুন্দর দেখেছ!
কীশ য়ুলের দিকে তাকাল কিন্তু কিছু বলল না।
য়ুল বিশাল স্ক্রিন থেকে চোখ ফিরিয়ে একবার কীশ আরেকবার ক্রনের দিকে তাকিয়ে বলল, কী হল? তোমরা কোনো কথা বলছ না কেন? তোমাদের কাছে সুন্দর মনে হচ্ছে না?
হচ্ছে। কীশ এক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, তবে
তবে কী?
আমি পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল বিশ্লেষণ করে দেখেছি—
কী দেখেছ?
দেখেছি এই বায়ুমণ্ডল বিষাক্ত।
য়ুল চমকে উঠে বলল, কী বললে?
কীশ কাতর মুখে বলল, আমি দুঃখিত য়ুল তুমি এত আশা করে সেই সুদূর ক্রসিয়াস গ্রহপুঞ্জ থেকে পৃথিবীতে এসেছ তোমার পূর্বপুরুষের জন্মগ্রহ দেখতে। কিন্তু পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল দেখে আমার মনে হচ্ছে–
কীশ হঠাৎ থেমে যায়। তারপর ইতস্তত করে বলল, মনে হচ্ছে—
কী মনে হচ্ছে?
মনে হচ্ছে এই গ্রহ প্রাণহীন।
প্রাণহীন?
হ্যাঁ। প্রাণহীন। বাতাসের ওজোন স্তর পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন, আলট্রা ভায়োলেট রে সরাসরি পৃথিবীকে আঘাত করেছে। বাতাসে মাত্রাতিরিক্ত ডায়োক্সিন, প্রয়োজনের অনেক বেশি কার্বন–ডাই–অক্সাইড, নানা ধরনের এসিড। সবচেয়ে যেটি ভয়ঙ্কর সেটি হচ্ছে অক্সিজেনের পরিমাণ এত কম যে পৃথিবীতে কোনো প্রাণ থাকার কথা নয়।
য়ুল অবিশ্বাসের ভঙ্গিতে মাথা নাড়তে থাকে, কী বলছ তুমি?
আমি দুঃখিত য়ুল। কিন্তু আমি সত্যি কথা বলছি।
য়ুল দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, তুমি বলছ পৃথিবী থেকে মানুষ নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে?
আমার তাই ধারণা। খুব নিম্ন শ্রেণীর প্রাণ, ভাইরাস, ব্যাকটেরিয়া বা সরীসৃপ হয়তো আছে কিন্তু কোনো বুদ্ধিমান প্রাণী নেই।
কেমন করে তুমি নিশ্চিত হলে কীশ?
মানুষ বুদ্ধিমান প্রাণী, তাদের একটি সভ্যতা ছিল। তারা বিজ্ঞানে খুব উন্নত ছিল। তারা যদি পৃথিবীতে বেঁচে থাকত তা হলে আমরা এখন তার চিহ্ন পেতাম। রেডিও তরঙ্গ দেখতে পেতাম, আলো দেখতে পেতাম, লেজার রশ্মি দেখতে পেতাম, পারমাণবিক বীম দেখতে পেতাম। আমরা পৃথিবী থেকে তার কোনো চিহ্ন পাচ্ছি না য়ুল। পৃথিবী যেন একটি মৃত গ্রহ।
য়ুল খুব সাবধানে কন্ট্রোল প্যানেলের সামনে রাখা একটি চেয়ারে বসে পড়ে, সে এখনো পুরো ব্যাপারটি বিশ্বাস করতে পারছে না। যে পৃথিবী এবং পৃথিবীর মানুষকে দেখার জন্য সে ছায়াপথের অন্য অংশ থেকে দীর্ঘ বারো বছর অভিযান করে এসেছে সেই পৃথিবী এখন প্রাণহীন? মানুষ পুরোপুরি অবলুপ্ত? য়ুল এক ধরনের বিস্ময় নিয়ে বড় স্ক্রিনটির দিকে নীল পৃথিবী, তার সাদা মেঘ, হালকা বাদামি স্থলভূমির দিকে তাকিয়ে থাকে। এই বিশাল পৃথিবীতে কোনো মানুষ বেঁচে নেই কেমন করে সে বিশ্বাস কবে?
কীশ একটু এগিয়ে য়ুলকে স্পর্শ করে বলল, আমি খুব দুঃখিত য়ুল। আমি খুবই দুঃখিত।
০২.
মহাকাশযানটি পৃথিবীকে ঘিরে কয়েকবার ঘুরে আসে, মহাকাশযানের সংবেদনশীল যন্ত্রপাতি পৃথিবীপৃষ্ঠকে তীক্ষ্ণভাবে পর্যবেক্ষণ করে, কয়েক শতাব্দী আগের একটি বিধ্বস্ত সভ্যতা ছাড়া সেখানে প্রাণের কোনো চিহ্ন নেই। ক্ৰন মহাকাশযানটির কক্ষপথ পরিবর্তন করে আরো নিচে নামিয়ে আনে, ক্ষীণ বায়ুমণ্ডলের ঘর্ষণে মহাকাশযানের চারপাশে এক ধরনের অতিপ্রাকৃত আলো জ্বলে ওঠে। ভিতরে তাপমাত্রা কয়েক শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে যায়। কীশ মহাকাশযানের তথ্যকেন্দ্রে পৃথিবীর সকল তথ্য বিশ্লেষণ করে য়ুলের কাছে জানতে চাইল সে পৃথিবীতে অবতরণ করতে চায় কি না। য়ুল কিছুক্ষণ শূন্য দৃষ্টিতে কীশের দিকে তাকিয়ে থেকে বলল, হ্যাঁ চাই।
তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ পৃথিবীতে নেমে শুধু তোমার আশাভঙ্গই হবে।
বুঝতে পারছি, তবু আমি নামতে চাই।
কীশ তবু একটু চেষ্টা করল, আমরা কিন্তু পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশের সকল তথ্য সংগ্রহ করে ফেলেছি। পৃথিবীতে নেমে নতুন কোনো তথ্য পাব না।
তবু আমি নামতে চাই। আমি নিজের চোখে দেখতে চাই।
বেশ। তা হলে আমরা মাঝারি একটা আন্তঃগ্রহ নভোযান নিয়ে নেমে যাই। ক্রন এই মহাকাশযানে থাকুক, আমাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করুক। কীশ য়ুলের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি তোমার সাথে যাই।
য়ুল নিচু গলায় বলল, আমার সাথে কারো যাবার প্রয়োজন নেই। আমি একাই যেতে পারব।
কীশ মাথা নাড়ল। বলল, আমি তোমাকে একা যেতে দিতে পারি না। এটি মহাকাশযানের নিরাপত্তা নীতিবহির্ভূত।
পৃথিবীতে কোনো জীবিত প্রাণী নেই। সেখানে কোনো বিপদ নেই কীশ।
হয়তো তোমার কথা সত্যি, কিন্তু আমরা কোনো ঝুঁকি নিতে পারি না।
বেশ। তবে তাই হোক।
কিছুক্ষণের মাঝে মহাকাশযানের আন্তঃগ্রহ নভোযানটিকে পৃথিবীতে নেওয়ার জন্য প্রস্তুত করা শুরু হয়। সেটিকে জ্বালানি দিয়ে পূর্ণ করা হয়। যোগাযোগ এবং নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হয়। পৃথিবীতে কিছুদিন থাকার মতো খাবার, পানীয় এবং বিশুদ্ধ বাতাস নেওয়া হয়। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি, বিপজ্জনক পরিবেশে বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় পোশাক, ভ্রমণ করার জন্য ক্ষুদ্র ভাসমান যান এবং কোনো কাজে লাগবে না সে বিষয়ে প্রায় নিশ্চিত হয়েও কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রও সাথে নিয়ে নেওয়া হয়।