দেখতে দেখতে তিন মাস পার হয়ে গেল। টুইটিকে নিয়ে প্রাথমিক উচ্ছ্বাসটুকু কেটে যাবার পরও নীলার উৎসাহে এতটুকু ভাটা পড়ে নি। সফটওয়্যার নিয়ে নতুন একটা প্রজেক্ট শুরু করার পর আবিদ হাসান হঠাৎ করে বাড়াবাড়ি ব্যস্ত হয়ে পড়লেন, মাঝখানে তাকে কয়েক সপ্তাহের জন্য জার্মানিও যেতে হল। জার্মানি থেকে ফিরে আসার সময় এবারে তার স্ত্রী এবং কন্যার জন্য ছোটখাটো উপহারের সাথে সাথে টুইটির জন্যও একটা উপহার কিনে আনলেন–একটা ফ্লী–কলার, কুকুরের গলায় বেঁধে রাখলে তার শরীরে উকুন হয় না!
জার্মানি থেকে ফিরে এসে অনেকদিন পরে রাত্রে একসাথে খেতে বসে আবিদ হাসান তার মেয়ের খোঁজ–খবর নিচ্ছিলেন। স্কুলের খবর, বন্ধুবান্ধবের খবর দিয়ে নীলা টুইটির খবর দিতে শুরু করল। বলল, আব্বু, টুইটি যা দুষ্টু হয়েছে তুমি সেটা বিশ্বাস করবে না।
নীলার গলায় অবশ্য টুইটির বিরুদ্ধে যেটুকু অভিযোগ তার চাইতে অনেক বেশি মমতার ছাপ ছিল। আবিদ হাসান মুখ টিপে হেসে বললেন, কী দুষ্টুমি করেছে, শুনি?
তাকে গল্প না বললে খেতে চায় না।
তাই নাকি?
হ্যাঁ, কিসের গল্প শুনতে সবচেয়ে বেশি পছন্দ করে বল দেখি?
কিসের?
একটা ছোট বাচ্চা আর তার মায়ের গল্প।
তাই নাকি?
হ্যাঁ।
নীলা আদুরে গলায় বলল, আচ্ছা আব্বু বল, প্রত্যেকদিন কি গল্প বলা যায়?
আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, ঠিকই বলেছি। এভাবে চলতে থাকলে তো তোর কুকুর ছানাকে পড়ার জন্য নার্সারি স্কুলে পাঠাতে হবে!
নীলা হেসে ফেলল, বলল, না আব্বু কুকুরকে নার্সারি স্কুলে পাঠাতে হবে না। আমি অনেক চেষ্টা করে দেখেছি টুইটির পড়াশোনায় কোনো উৎসাহ নেই। ডাবলিউ আর এম উল্টাপাল্টা করে ফেলে।
তাই নাকি?
হ্যাঁ। আর কিছুতেই নয়ের বেশি গুনতে পারে না। দশ লিখলেই টুইটির মাথা আউলা–ঝাউলা হয়ে যায়! একবার বলে এক আরেকবার বলে শূন্য।
আবিদ হাসান হঠাৎ একটু অবাক হয়ে নীলার দিকে তাকালেন, এতক্ষণ টুইটির সম্পর্কে যেসব কথা বলে গেছে তার কোনোটাই তিনি খুব বেশি গুরুত্ব দিয়ে নেন নি, নীলার শেষ কথাটি শুনে তিনি রীতিমতো চমকে উঠলেন। জিজ্ঞেস করলেন, কী বললি তুই?
নীলা গাল ফুলিয়ে বলল, তার মানে তুমি আমার কোনো কথা শোন নি?
কে বলেছে শুনি নি। সব শুনেছি।
তা হলে আবার জিজ্ঞেস করছ কেন?
তুই সত্যি বলেছিস নাকি ঠাট্টা করছিস জানার জন্য।
ঠাট্টা করব কেন? নীলা মুখ গম্ভীর করে বলল, তোমার মনে নেই টুইটির দাম সাড়ে সাত হাজার ডলার? সে সবকিছু বোঝে।
পাগলী মেয়ে, দাম বেশি হলেই সবকিছু বুঝবে কে বলেছে? সবকিছুর একটা সীমা থাকে। খুব বুদ্ধিমান কুকুরেরও বুদ্ধির একটা সীমা থাকবে।
নীলা বুক ফুলিয়ে বলল, আমার টুইটির বুদ্ধির কোনো সীমা নেই।
তুই যা বলেছিস সেটা সত্যি হলে আসলেই তোর টুইটির বুদ্ধির কোনো সীমা নেই।
তুমি কী বলছ আব্বু? আমি কি তোমাকে মিথ্যে বলেছি?
ইচ্ছে করে হয়তো বলিস নি কিন্তু যেটা বলছিস সেটা সত্যি হতে পারে না। মানুষ ছাড়া অন্য কোনো প্রাণী খুব বেশি দূর গুনতে পারে না।
নীলা মুখ গম্ভীর করে বলল, টুইটি পারে। আমি তোমাকে দেখাব।
ঠিক আছে। আবিদ হাসান খেতে খেতে বললেন, যেটা হয়েছে সেটা এ রকম, তোর টুইটি কিছু শব্দ শুনে কিছু কাজ করে, শব্দগুলো যে সংখ্যা সেটা সে জানে না। অনেকটা ময়না পাখির কথা বলার মতো। ময়না পাখি যে কথা বলে সেটা তারা বুঝে বলে না–তারা শুধু এক ধরনের শব্দ করে। বুঝেছিস!
নীলা বলল, আমি বুঝেছি আব্বু, তুমি কিছু বোঝ নি।
মুনিরা হাসান এবারে মুখ ঝামটা দিয়ে বললেন, অনেক হয়েছে। এখন দুজনেই কথা বন্ধ করে খাও।
পরদিন অফিস থেকে এসে আবিদ হাসান টুইটির বুদ্ধিমত্তা পরিমাপ করতে বসলেন। নীলাকে ডেকে বললেন, নিয়ে আয় দেখি টুইটিকে।
নীলা গলা উঁচিয়ে ডাক দিল, টু–ই–টি।
সাথে সাথেই বাসার পিছন থেকে টুইটি ছুটে এসে নীলাকে ঘিরে লাফাতে শুরু করল। আবিদ হাসান একটু অবাক হয়ে দেখলেন টুইটি এর মাঝে বেশ বড় হয়েছে, তার মাঝে কুকুর ছানা কুকুর ছানা ভাব আর নেই। নীলা আঙুল উঁচিয়ে বলল, আম্মু তোকে এখন পরীক্ষা করে দেখবে। বুঝেছিস?
আবিদ হাসান সকৌতুকে দেখলেন মানুষ যেভাবে সম্মতি জানিয়ে মাথা নাড়ে, টুইটি। ঠিক সেভাবে মাথা নাড়ল–যেন সে সত্যি সত্যি নীলার কথা বুঝতে পেরেছে। নীলা বলল, আমি যখন বলব এক তখন তুই একবার পা উপরে তুলবি, এইভাবে– বলে নীলা তার। নিজের পা উপরে তুলল, বুঝেছিস?
টুইটি তার পা একবার উপরে তুলল, তারপর হ্যা–সূচকভাবে মাথা নাড়ল। নীলা এবার জোরে জোর বলল, এক।
টুইটি তখন তার পাটি একবার উপরে তুলে আবার নামিয়ে আনে। নীলা বলল দুই তখন টুইটি তার পাটি একবার উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে তারপর আবার দ্বিতীয়বার উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে। নীলা এবারে বলল, তিন টুইটি সত্যি সত্যি তিনবার তার পা উপরে তুলে নিচে নামিয়ে আনে। নীলা এইভাবে গুনে যেতে থাকে এবং প্রত্যেকবারই টুইটি সঠিক সংখ্যকভাবে তার পা উপরে তুলে এবং নিচে নামিয়ে আনে। আট পর্যন্ত গিয়ে অবশ্য গুলিয়ে ফেলল এবং প্রথমবার ভুল করে ফেলল। নীলা হাল ছেড়ে না দিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করতে যাচ্ছিল, আবিদ হাসান তাকে থামালেন, বললেন, আর করতে হবে না। আমি দেখেছি।