চমৎকার। ডক্টর আজহারের গলার স্বর আবার গম্ভীর হয়ে আসে, সে একটু সামনে ঝুঁকে বলল, তা হলে তোমার আব্বুর সাথে কিছু কাগজপত্র তৈরি করে নেওয়া যাক। কাল ভোরে তোমার বাসায় চমৎকার একটা আইরিশ টেরিয়ার কুকুর ছানা চলে আসবে!
নীলা চকচকে চোখে বলল, আমি কি আমার কুকুর ছানাটিকে দেখতে পারি?
ডক্টর আজহার এক মুহূর্ত কী যেন ভাবল, তারপর বলল, এস আমার সাথে।
ডক্টর আজহারের পিছু পিছু আবিদ হাসান এবং নীলা একটি বড় হলঘরে হাজির হল। ঘরের দেয়ালে অনেকগুলো বড় বড় টেলিভিশন স্ক্রিন। একেকটা স্ক্রিনে একেকটি ভিন্ন ভিন্ন দৃশ্য। কোনোটিতে বড় একটি ল্যাবরেটরিতে মানুষেরা কাজ করছে, কোথাও বড় গুদামঘর। থেকে জিনিসপত্র সরানো হচ্ছে, কোথাও খাচায় রাখা বড় বড় কুকুর, কোথাও বিচিত্র ধরনের যন্ত্রপাতি। ডক্টর আজহার সুইচপ্যানেল স্পর্শ করতেই একটা স্ক্রিনের দৃশ্য পাল্টে যায় এবং সেখানে ধবধবে সাদা কুকুর ছানার ছবি ফুটে ওঠে। কুকুর ছানাটি স্থির দৃষ্টিতে কোথায় জানি তাকিয়ে আছে।
ডক্টর আজহার নীলাকে বলল, এই যে, তোমার কুকুর ছানা।
নীলা বুকের মাঝে আটকে রাখা নিশ্বাসটি বের করে দিয়ে বলল, ইস্! কী সুন্দর!
আবিদ হাসানকেও স্বীকার করতে হল কুকুর ছানাটি সত্যিই ভারি সুন্দর! শিশু–তা সে মানুষেরই হোক আর পশুপাখিরই হোক, সব সময়ই সুন্দর।
০৩.
নীলার কুকুর ছানা নিয়ে মুনিরা হাসানের প্রকাশ্যে এবং আবিদ হাসানের গোপনে যেটুকু দুশ্চিন্তা ছিল পেট ওয়ার্ল্ডের কাজকর্ম দেখে তার পুরোটাই দূর হয়ে গেল। পেট ওয়ার্ল্ড যে নীলার জন্য শুধু একটি ধবধবে সাদা কুকুর ছানা দিয়ে গেল তা নয়, কুকুর ছানাটিকে দেখেশুনে রাখার জন্য যা যা প্রয়োজন তার সবকিছুর ব্যবস্থা করে দিয়ে গেল। তারা বাসার সামনে মোল্ডেড প্লাস্টিকের সুন্দর ঘর, প্রথম তিন মাসের খাবার এবং ওষুধপত্র, কুকুর ছানা পরিচর্যা করার উপরে বই, কাগজপত্র এমনকি একটা ভিডিও এবং কুকুর ছানার বুদ্ধিমত্তা বিকাশের জন্য কী কী করতে হবে সেসব ব্যাপারেও নীলার সাথে আলাপ করে গেল। কুকুর ছানার দৈনন্দিন তথ্য পাঠানোর জন্য একটি ই–মেইল একাউন্ট এমনকি জরুরি প্রয়োজনে যোগাযোগ করার জন্য সার্বক্ষণিক একটি টেলিফোন নম্বরও দিয়ে গেল।
কয়েকদিনের মাঝেই কুকুর ছানাটির উপস্থিতিতে বাসার সবাই মোটামুটি অভ্যস্ত হয়ে যায়। কুকুর ছানাটি শান্ত এবং আমুদে। নীলার মনোরঞ্জনের জন্য খুব ব্যস্ত এবং অত্যন্ত সুবোধ। কোন জিনিসটি করতে পারবে এবং কোন জিনিসটি করতে পারবে না সেটি একবার বলে দেওয়া হলেই কুকুর ছানাটি সেটি মনে রাখে এবং মেনে চলে। সারা রাত জেগে থেকে কেউকেউ চিৎকার করে সারা বাড়ি মাথায় তুলে সবার জীবন অতিষ্ঠ করে দেবে বলে যে ভয়টা ছিল দেখা গেল সেটা পুরোপুরি অমূলক। রাত্রে ঘুমানোর সময় কুকুর ছানাটিকে তার। ঘরে ঢুকিয়ে বাইরে থেকে দরজা বন্ধ করে দেওয়ামাত্রই সে দুই পায়ের মাঝে মাথা ঢুকিয়ে ব্যাপারটি মেনে নেয়।
কুকুর ছানাটির কী নাম দেওয়া যায় সেটি নিয়ে অনেক জল্পনাকল্পনা হল এবং শেষ পর্যন্ত নীলার যে নামটি পছন্দ সেটি হচ্ছে টুইটি। আবিদ হাসানের ধারণা ছিল এই নামটিতে অভ্যস্ত হতে কুকুর ছানা সপ্তাহখানেক সময় নেবে কিন্তু দেখা গেল এক বেলার মাঝে কুকুর ছানাটি তার নতুন নামে অভ্যস্ত হয়ে গেছে। জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যবহার করে সত্যি সত্যি কুকুরের মাঝে বুদ্ধিমান প্রজাতি তৈরি করা সম্ভব সেটি আবিদ হাসান এই প্রথমবার একটু একটু বিশ্বাস করতে শুরু করলেন।
কিছুদিনের মাঝেই বাসার সবাই কুকুর ছানা টুইটিকে বেশ পছন্দ করে ফেলল। নীলা। স্কুল থেকে আসার পরই টুইটিকে নিয়ে ছোটাছুটি করে। সত্যি কথা বলতে কী, আবিদ হাসানও বিকেলবেলা টুইটি নামের এই আইরিশ টেরিয়ার কুকুর ছানাটিকে নিয়ে খানিকক্ষণ খেলার জন্য বেশ আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করে থাকেন। মুনিরা হাসান যদিও নিজে থেকে এখনো টুইটির সাথে কোনো রকম মাখামাখি করেন নি, কিন্তু বারান্দায় বসে থেকে তার স্বামী এবং কন্যাকে এই কুকুর ছানাটিকে নিয়ে বড় ধরনের হইচই করতে দেখা বেশ পছন্দই করেন। নির্বোধ পশুপাখি সম্পর্কে তার যেরকম একটি ধারণা ছিল টুইটিকে কাছাকাছি দেখে তার বেশ একটা বড় পরিবর্তন হয়েছে।
আবিদ হাসান যেটুকু জানেন সে অনুযায়ী পেট ওয়ার্ল্ড এখনো পুরোপুরি ব্যবসা শুরু করে নি। ডক্টর আজহারের সাথে কথা বলে যেটুকু বুঝেছিলেন তাতে মনে হয় মোটামুটি নিয়মিতভাবে বুদ্ধিমান প্রজাতির কুকুর ছানা তৈরি করতে শুরু করার এখনো বছর দুয়েক সময় বাকি। যে। কোনো ব্যবসার গোড়ার দিকে একটা সময় থাকে যখন সেটি দাঁড়া করানোর জন্য তার পিছনে। প্রচুর টাকা ঢালতে হয়। পেট ওয়ার্ল্ড সে ব্যাপারে নিশ্চয়ই ভালোভাবে প্রস্তুত। তারা শুধু যে। তাদের প্রতিষ্ঠানটিকে চালিয়ে যাচ্ছে তাই নয়, টঙ্গীর আশপাশে বেশ কিছু দাঁতব্য সেবা প্রতিষ্ঠানও খুলেছে। সেখানে গরিব মানুষজন বিনা খরচে চিকিৎসা পেতে পারে, বিশেষ করে সন্তানসম্ভবা মায়েদের চিকিৎসার খুব ভালো এবং আধুনিক ব্যবস্থা রয়েছে। আমেরিকান বড় করপোরেশনগুলো স্থানীয় এলাকায় সবসময়েই এ ধরনের নানারকম আয়োজন করে থাকে, তার সবগুলোই যে মানুষের জন্য ভালবাসার কারণে হয়ে থাকে তা নয়। ট্যাক্স ফাঁকি দেওয়া থেকে শুরু করে স্থানীয় মানুষজনের সাথে ভালো সম্পর্ক গড়ে তোলা জাতীয় ব্যাপারগুলোই আসলে মূল উদ্দেশ্য। নিজেরা যখন বিশাল অর্থের পাহাড় গড়ে তুলবে তখন তার একটি অংশ যদি গরিব দুঃখী মানুষের জন্য খরচ করা হয় খারাপ কী?