গাড়ি ভিতরে ঢুকতেই নীলা বলল, কী সুন্দর! দেখেছ আব্বু?
আবিদ হাসান মাথা নাড়লেন, সত্যিই সুন্দর। বাইরে থেকে বোঝা যায় না ভিতরে এত জায়গা। সুবিস্তৃত লনে গাছগাছালি এবং ফুলের বাগান, পিছনে বিশাল আলোকোজ্জ্বল দালান। পুরো জায়গাটুকুতে এক ধরনের দীর্ঘ পরিকল্পনার ছাপ রয়েছে, আবিদ হাসানের। মনে হল তিনি বুঝি পাশ্চাত্যের কোনো একটি বড় করপোরেট অফিসে ঢুকে গেছেন।
গাড়ি পার্ক করার জন্য জায়গা নির্দিষ্ট করা হয়েছে, সেখানে গাড়ি রেখে আবিদ হাসান নীলার হাত ধরে খোয়া বাধানো হাঁটা পথে মূল দালানে পৌঁছলেন। বড় কাঁচের স্লাইডিং দরজার সামনে দাঁড়াতেই সেটা নিঃশব্দে খুলে গেল। আবিদ হাসান ভিতরে পা দিতেই কেন্দ্রীয় শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের আরামদায়ক অনুভূতি তার সারা শরীর জুড়িয়ে দিল। দরজার অন্যপাশে একজন তরুণী দাঁড়িয়ে ছিল, আবিদ হাসান এবং নীলাকে দেখে সে তাদের দিকে এগিয়ে এল। মেয়েটির ফোলানো চুল এবং পরিমিত প্রসাধন চেহারায় এক ধরনের আকর্ষণীয়। এবং মাপা কমনীয়তা নিয়ে এসেছে। মেয়েটি মিষ্টি করে হেসে বলল, আসুন। আমি জেরিন। পেট ওয়ার্ডে আপনাকে স্বাগত জানাচ্ছি।
আমি আবিদ হাসান আর এ হচ্ছে আমার মেয়ে নীলা।
আসুন মি. হাসান। আপনার জন্য ডক্টর আজহার অপেক্ষা করছেন।
ডক্টর আজহার?
হ্যাঁ। আমাদের ম্যানেজিং ডিরেক্টর। এই পুরো প্রজেক্টটা ডক্টর আজহারের ব্রেইন চাইল্ড।
আবিদ হাসান বড় একটা হলঘরের ভিতর দিয়ে হেঁটে একটা লিফটের সামনে পঁড়ালেন। বোতাম স্পর্শ করামাত্র লিফটের দরজা নিঃশব্দে খুলে গেল। জেরিন আবিদ হাসান এবং নীলাকে নিয়ে লিফটে করে সাত তলায় এসে একটা দীর্ঘ করিডোর ধরে হেঁটে বড় একটা ঘরের সামনে দাঁড়াল। দরজার পাশে একটা সেক্রেটারিয়েট ডেস্ক, সেখানে ইন্টারকমে চাপ দিয়ে জেরিনা নিচু গলায় বলল, স্যার, আপনার গেস্টদের নিয়ে এসেছি।
আবিদ হাসান ইন্টারকমে একটা মোটা গলার আওয়াজ শুনতে পেলেন, ভিতরে নিয়ে এস।
জেরিন দরজা ঠেলে খুলে দিয়ে আবিদ হাসান এবং নীলাকে ভিতরে যেতে ইঙ্গিত করল। আবিদ হাসান নীলার হাত ধরে ভিতরে ঢুকলেন। বিশাল একটি অফিস ঘর, অন্যপাশে একটা বড় ডেস্কে পা তুলে একজন মানুষ তার রিভলবিং চেয়ারে আধশোয়া হয়ে বসে কিছু একটা পড়ছিল, আবিদ হাসান এবং নীলাকে ঢুকতে দেখে মানুষটি পা নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে তাদের দিকে এগিয়ে এল। এ রকম বিশাল একটি প্রতিষ্ঠান যার পরিকল্পনায় গড়ে উঠেছে সেই মানুষটিকে তুলনামূলকভাবে বেশ কম বয়স্ক মনে হল–আবিদ হাসান থেকে বড়জোর বছর পাঁচেকের বড় হবে। মানুষটি দীর্ঘদেহী এবং সুদর্শন, চোখে সূক্ষ্ম ধাতব রীমের চশমা। মাথায় এলোমেলো চুল, গায়ের রং অস্বাভাবিক ফর্সা–এই বয়সেও রোদে পুড়ে তামাটে হয়ে যায় নি।
মানুষটি লম্বা পা ফেলে এগিয়ে এসে আবিদ হাসানের সাথে করমর্দন করে বলল, আমি আসিফ আহমেদ আজহার। আমার বন্ধুরা ঠাট্টা করে বলে ট্রিপল–এ।
আবিদ হাসান হাসলেন, ভাগ্যিস আপনি আমেরিকাতে নেই, তা হলে যত ভাঙা গাড়ি তাদের ড্রাইভারের ফোনের উত্তর দিতে দিতে আপনার জান বের হয়ে যেত।
যুক্তরাষ্ট্রের মোটর গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের প্রতিষ্ঠান আমেরিকান অটোমোবাইল এসোসিয়েশনের নামের আদ্যক্ষরের সাথে ডক্টর আজহারের নামের মিলটুকু আবিদ হাসান ঠিক ঠিক ধরতে পেরেছেন দেখে মানুষটি বেশ সন্তুষ্ট হল। সে আবিদ হাসান এবং নীলাকে তার ডেস্কের সামনে রাখা গদিসাঁটা চেয়ারে বসিয়ে নিজের জায়গায় বসে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি সিকিউরিটি গার্ডের ব্যবহারের জন্য আপনার কাছে ক্ষমা চাইছি।
আবিদ হাসান ঠিক কী বলবেন বুঝতে পারলেন না। ভদ্রতাসূচক কিছু একটা বলতে যাচ্ছিলেন তার আগেই ডক্টর আজহার বলল, আমি অবশ্য সিকিউরিটি গার্ডের দোষও দিতে পারছি না। আমরা বেছে বেছে এমন মানুষকে সিকিউরিটি গার্ডের দায়িত্বে দেই যাদের আই. কিউ, খুব বেশি নয়। খানিকটা রোবটের মতো মানুষ! তাদের কাছে খুব ভদ্রতা আশা করাও অন্যায় হবে।
আবিদ হাসান মানুষটিকে তীক্ষ্ণ চোখে লক্ষ করতে থাকলেন। মানুষটির সপ্রতিভ আন্তরিক কথাবার্তার পরেও তার ভিতরে কিছু একটা তাকে এক ধরনের অস্বস্তির মাঝে ফেলে দেয়। মানুষটি এবারে হঠাৎ করে নীলার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী খাবে বল? আইসক্রিম, কোল্ড ড্রিংকস, হট চকলেট?
নীলা আইসক্রিম খুব পছন্দ করে কিন্তু সেটা মুখ ফুটে বলল না, মাথা নেড়ে বলল, কিছু খাব না।।
কিছু একটা তো যেতে হবে। মানুষটি নীলার দিকে চোখ মটকে বলল, ঠিক আছে আইসক্রিমই হোক। আমার কাছে খুব ভালো আইসক্রিম আছে। স্ট্রবেরি উইথ হেজল নাট।
ইন্টারকমে চাপ দিয়ে এই সপ্রতিভ মানুষটি নীলার জন্য আইসক্রিম এবং তাদের দুজনের জন্য কফির কথা বলে আবার আবিদ হাসানের দিকে ঘুরে তাকাল। আবিদ হাসান একটু ইতস্তত করে বললেন, আমি ঠিক বুঝতে পারছি না–আপনি কি শুধু সিকিউরিটি গার্ডের হয়ে ক্ষমা চাইবার জন্য আমাদের ডেকেছেন?
মানুষটি হা হা করে হেসে উঠে বলল, না। আমি সে জন্য আপনাদের কষ্ট দিই নি। আমাদের এই ফ্যামিলিটির সিকিউরিটি সিস্টেম একেবারে স্টেট অফ দি আর্ট। আমি এখানে বসে সবকিছু মনিটর করতে পারি। ঘটনাক্রমে আমি আপনার সাথে গার্ডের কথা শুনতে পেরেছি। আপনি আপনার মেয়ের জন্য একটা কুকুর ছানা খুঁজছেন।