কাজটি যেরকম সহজ হবে বলে তিনি মনে করেছিলেন দেখা গেল সেটা মোটেও তত সহজ নয়। কাটাবনে সারি সারি দোকান রয়েছে সত্যি কিন্তু সেখানে কুকুর বলতে গেলে নেই। এক দুটি দোকানে কিছু ঘেয়ো কুকুর ছোট পঁচার মাঝে বেঁধে রাখা হয়েছে। দানাপানি না দিয়ে ছোট খাঁচার মাঝে বেঁধে রাখার ফলে তাদের মেজাজ হয়ে আছে তিরিক্ষে, কাছে যেতেই সবগুলো একসাথে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে উঠল। খুঁজে পেতে একটা দোকানে একটা বিদেশী কুকুরের বাচ্চা পাওয়া গেল, এক সময় তার গায়ের রং নিশ্চয়ই ধবধবে সাদা ছিল কিন্তু এখন অযত্নে ময়লা হয়ে আছে। কুকুর ছানাটা নির্জীব হয়ে শুয়ে ছিল। নীলা কাছে গিয়ে ডাকাডাকি করেও তাকে দাঁড়া করাতে পারল না।
নীলা এবং আবিদ হাসান যখন কী করবেন সেটা নিয়ে কথা বলছেন তখন দোকানের একজন কর্মচারী তাদের দিকে এগিয়ে এল, বলল, কুকুর কিনবেন?
হ্যাঁ। কুকুরের বাচ্চা!
মানুষটি আবিদ হাসানের চোখের দিকে তাকিয়েই বুঝতে পারল চেষ্টা চরিত্র করে সে তার দোকানের কোনো কুকুর গুছিয়ে দিতে পারবে না, তাই সেদিকে আর চেষ্টা করল না। বলল, এভাবে তো ভালো কুকুর পাবেন না। সাপ্লাই তো কম। ঠিকানা–টেলিফোন রেখে যান ভালো বাচ্চা এলে ধোজ দেব।
কবে আসবে?
কোনো ঠিক নাই। আজকেও আসতে পারে, এক মাস পরেও আসতে পারে।
নীলার মুখের দিকে তাকিয়ে আবিদ হাসানের মন খারাপ হল, জিজ্ঞেস করলেন, আর কোনো কুকুরের দোকান নাই?
না। তবে
তবে?
শুনেছি টঙ্গীর কাছে নাকি একটা পোষা কুকুরের ফার্ম খুলছে।
কুকুরের ফার্ম? আবিদ হাসান খুব অবাক হলেন। কুকুরের আবার ফার্ম হয় নাকি?
তাই তো শুনেছি। সব নাকি বিদেশী কুকুর।
তাই নাকি?
জে।
সেই ফার্মে কী হবে?
মাছের যেরকম চাষ হয় সেরকম কুকুরের চাষ হবে। দোকানের কর্মচারী নিজের রসিকতায় নিজেই হেসে ফেলল।
কী হবে কুকুরের চাষ করে?
জানি না। কেউ বলে কোরিয়ায় কুকুরের মাংস রপ্তানি করবে। কেউ বলে ল্যাবরেটরিতে গবেষণার জন্য পাঠাবে। কেউ বলে পুলিশের কাছে বিক্রি করবে।
আবিদ হাসান কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ফার্মটা কোথায়?
সেটা তো জানি না। শুনেছি টঙ্গীর কাছে আমেরিকান কোম্পানি।
নাম কী কোম্পানির?
মানুষটা মুখ সুচালো করে নামটা মনে করার চেষ্টা করে বেশি সুবিধে করতে পারল না, তখন ভিতরে ঢুকে কাগজ ঘাঁটাঘাঁটি করে একটা ময়লা কাগজে নাম লিখে আনল, পেট ওয়ার্ল্ড–পোষা প্রাণীর জগৎ।
আবিদ হাসান মেয়েকে কথা দিলেন পরের দিনই তিনি পেট ওয়ার্ল্ডের খোঁজ নেবেন।
.
আমেরিকান কোম্পানি হইচই করে বিদেশী কুকুরের একটা বিশাল ফার্ম বসালে সেটা খুঁজে পাওয়া সহজ হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু পেট ওয়ার্ল্ড খুঁজে বের করতে আবিদ হাসানের কালো ঘাম ছুটে গেল। আজ সকাল সকাল অফিস থেকে বের হয়েছেন, নীলাকে নিয়ে টঙ্গী এসে পেট ওয়ার্ল্ড খোজা শুরু করেছেন, সন্ধে ঘনিয়ে যাবার পর যখন তিনি আশা ছেড়ে দিয়েছেন তখন পেট ওয়ার্ল্ডের খোঁজ পাওয়া গেল। বড় রাস্তার পাশে বেশ বড় একটা জায়গা উঁচু দেয়াল এবং কাটাতার দিয়ে ঘেরা। ভিতরে জেলখানার মতো বড় একটা দালান। সামনে শক্ত লোহার গেট এবং গেটের পাশে ছোট পেতলের একটা নামফলক, সেখানে আরো ছোট করে ইংরেজিতে লেখা পেট ওয়ার্ল্ড!
আবিদ হাসান গেটের সামনে দাঁড়িয়ে তার গাড়ির হর্ন বাজালেন। বার দুয়েক শব্দ করার পর প্রথমে গেটের উপরে ছোট চৌকোনা একটা জানালা খুলে গেল। সেখান থেকে একজন মানুষ উঁকি দিয়ে তাকে দেখল, তারপর গেটের পাশ থেকে নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা একজন মানুষ বের হয়ে এল, আবিদ হাসানের কাছে এসে দাঁড়িয়ে মানুষটি জিজ্ঞেস করল, কাকে চান?
আবিদ হাসান একটু বিপন্ন অনুভব করলেন, তার মনে হল তিনি বুঝি কোনো ভুল জায়গায় চলে এসেছেন। একটু ইতস্তত করে বললেন, আসলে আমি একটা কুকুর ছানা কিনতে এসেছি।
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি কঠিন মুখে বলল, এখানে কুকুর ছানা বিক্রি হয় না।
আমাকে একজন বলল এখানে নাকি কুকুরের ফার্ম তৈরি হয়েছে।
মানুষটি নিস্পলক চোখে আবিদ হাসানের দিকে তাকিয়ে থেকে গলায় খানিকটা অনাবশ্যক রূঢ়তা ঢেলে বলল, আমি আপনাকে বলেছি, এখানে কুকুর বিক্রি হয় না।
মানুষটির ব্যবহারে আবিদ হাসান অত্যন্ত বিরক্ত হলেন। তিনি রুষ্ট গলায় বললেন, তা হলে এখানে কী হয়?
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি আবিদ হাসানের কথার উত্তর দেবার কোনো প্রয়োজনীয়তা অনুভব করল না। সে পিছন ফিরে তার গেটের কাছে ফিরে যেতে থাকে, ঠিক তখন তার কোমরে ঝোলানো ওয়াকিটকিতে কেউ একজন তার সাথে যোগাযোগ করল। মানুষটি ওয়াকিটকিটি মুখের কাছে ধরে বাক্য বিনিময় শুরু করে, কী নিয়ে কথা বলছে সেটি শুনতে না পেলেও আবিদ হাসান বুঝতে পারলেন মানুষটি তাকে নিয়ে কথা বলছে। এক্সেলেটরে চাপ দিয়ে গাড়ি ঘুরিয়ে নিতে গিয়ে তিনি থেমে গেলেন, কারণ তিনি দেখতে পেলেন নিরাপত্তারক্ষী মানুষটি তার দিকে এগিয়ে আসছে।
আপনি ভিতরে যান।
আবিদ হাসান ভুরু কুঁচকে বললেন, এখানে যদি কুকুর বিক্রি না হয় তা হলে আমি গিয়ে কী করব?।
নিরাপত্তারক্ষীর পোশাক পরা মানুষটি আবিদ হাসানের উত্মাটুকু হজম করে নিয়ে তার হাতের স্বয়ংক্রিয় একটা সুইচে চাপ দিতেই সামনের গেটটি ঘরঘর শব্দ করে খুলতে শুরু করে। তার গাড়িটা যাওয়ার মতো জায়গা করে গেটটা থেমে গেল। আবিদ হাসান গাড়ি ঘুরিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলেন।