আবিদ হাসান নীলার আক্রমণ থেকে নিজেকে রক্ষা করে বললেন, কুকুর ছানা?
হ্যাঁ। এইটুকুন তুলতুলে কুকুর ছানা।
আবিদ হাসান পুরো ব্যাপারটুকু হেসে উড়িয়ে দিতে গিয়ে তার আদরের মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থেমে গেলেন। ব্যাপারটা সরাসরি উড়িয়ে দেওয়া যাবে না–একটু গুরুত্ব দিয়ে কথা বলে নিতে হবে। তিনি মুখে খানিকটা গাম্ভীর্য টেনে এনে বললেন, একটা কুকুর ছানা কিন্তু একটা খেলনা নয়, জানিস তো?
জানি।
মজা ফুরিয়ে গেলে একটা খেলনা যেরকম সরিয়ে রাখা যায় একটা কুকুরের বেলায় কিন্তু সেটা করা যায় না।
নীলা চোখ বড় বড় করে বলল, জানি বাবা, সেজন্যই তো চাইছি।
বাসায় একটা কুকুর ছানা আনলে তাকে কিন্তু চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে হবে। খাওয়াতে হবে, পরিষ্কার রাখতে হবে, তার সাথে খেলতে হবে, তাকে বড় করতে হবে।
করব বাবা। নীলা উজ্জ্বল চোখে বলল, আমি যেখানেই যাব সেখানেই আমার পিছু পিছু ঘুরে বেড়াবে, কী মজা হবে!
আবিদ হাসান মুখ আরো গম্ভীর করে বললেন, এখন ভাবতে খুব মজা লাগছে, কিন্তু মনে রাখিস যখন তার পিছনে চব্বিশ ঘণ্টা সময় দিতে হবে তখন কিন্তু মজা উবে যাবে।
যাবে না।
তোর কুকুর ছানা যখন বাথরুম করবে, সেগুলো পরিষ্কার করতে হবে। পারবি?
নীলাকে এবারে একটু বিভ্রান্ত দেখাল, কুকুর ছানা যে বাথরুম করতে পারে এই ব্যাপারটি সে আগে ভেবে দেখে নি। এক মুহূর্ত ইতস্তত করে মুখ শক্ত করে বলল, পারব আব্বু।
আবিদ হাসান একটু হাসলেন, বললেন, এখন বলা খুব সোজা, যখন সত্যি সত্যি করতে হবে তখন পিছনের দরজা দিয়ে পালিয়ে যাবি!
নীলা তার বাবার গলা জড়িয়ে ধরে আদুরে গলায় বলল, যাব না বাবা–প্লিজ কিনে দাও!
আবিদ হাসান একটা নিশ্বাস ফেললেন। নীলা তার একমাত্র মেয়ে, খুব আদরের মেয়ে। ভারি লক্ষ্মী মেয়ে, কখনো বাবা–মাকে জ্বালাতন করেছে বলে মনে পড়ে না। কোনো কিছু চাইলে না বলেছেন মনে পড়ে না, কিন্তু বাসায় একটা পোষা কুকুর সেটি তো অনেক বড় ব্যাপার, তার অর্থ জীবন পদ্ধতির সবকিছু ওলটপালট হয়ে যাওয়া।
নীলা খুব আশা নিয়ে তার বাবার মুখের দিকে তাকাল, বলল, দেবে আব্বু?
আবিদ হাসান মেয়েকে নিজের কাছে টেনে এনে বললেন, দেখ, একটা পোষা কুকুর আসলে বাসার নতুন একটা মানুষের মতো। এত মায়া হয়ে যাবে যে যদি কিছু একটা হয়ে যায় তা হলে কেঁদে কূল পাবি না।
কী হবে আব্বু?
এই ধর যদি হারিয়ে যায় কিংবা মরে যায়
কেন হারিয়ে যাবে আব্বু? কেন মরে যাবে? আমি এত যত্ন করে রাখব যে তুমি অবাক হয়ে যাবে।
আবিদ হাসান মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে বললেন, তুই আরো কয়টা দিন একটু চিন্তা করে দেখ। এখনই ঠিক করে ফেলতে হবে কে বলেছে?
কুকুরের বাচ্চার প্রস্তাবটা যখন নীলার মা মুনিরা হাসান শুনলেন তখন সেটা একেবারে এক কথায় নাকচ করে দিলেন। মুখ শক্ত করে বললেন, ফাজলেমি পেয়েছ? এমনিতেই জান বের হয়ে যাচ্ছে এখন বাসায় একটা কুকুর নিয়ে আসবে? ছিঃ!
নীলার মা মুনিরা হাসানের গলার স্বর সব সময় চড়া সুরে বাঁধা থাকে, তিনি নরম বা কোমল গলায় কথা বলেন না। কাজেই এক কথায় কুকুরের বাচ্চা পোষার শখটাকে বাতিল করে দেওয়ায় নীলার চোখে পানি টলটল করে উঠল এবং বলা যেতে পারে তখন আবিদ হাসান তার মেয়ের সাহায্যে এগিয়ে এলেন। বললেন, আহা, মুনিরা, ওরকম করে বলছ কেন? কুকুর–বেড়াল পোষা তো খারাপ কিছু না।
মুনিরা কোমরে হাত দিয়ে বললেন, এখন তুমিও মেয়ের সাথে তাল দিচ্ছ?
বেচারি একা একা থাকে, একটা সঙ্গী হলে খারাপ কী? পোষা পশুপাখি থাকলে একটা দায়িত্ব নেওয়া শিখবে।
বাসায় দায়িত্ব নেওয়ার জিনিসের অভাব আছে? ঘরদোর পরিষ্কার রাখতে পারে না? নিজের ঘরটা গুছিয়ে রাখতে পারে না? বাসার কাজকর্মে সাহায্য করতে পারে না?
কাজেই নীলার কুকুর পোর ব্যাপারটি আপাতত চাপা পড়ে গেল। বাবাকে নিজের পক্ষে পেয়ে নীলা অবশ্য এত সহজে হাল ছেড়ে দিল না, সে ধৈর্য ধরে লেগে রইল। আবিদ হাসান মেয়ের পক্ষ নেওয়ায় শেষ পর্যন্ত মুনিরা একটু নরম হলেন এবং শেষ পর্যন্ত একদিন নীলা কুকুর পোষার অনুমতি পেল। অনুমতিটি হল সাময়িক নীলার আম্মা খুব স্পষ্ট করে বলে রাখলেন যদি দেখা যায় নীলা ঠিক করে তার পোষা কুকুরের যত্ন নিতে পারছে না তা হলে সাথে সাথে কুকুর ছানাকে গৃহ ত্যাগ করতে হবে।
০২.
আবিদ হাসান একটা সফটওয়্যার কোম্পানিতে চাকরি করেন, বড় একটা প্রজেক্ট ম্যানেজার হিসেবে তাকে এত ব্যস্ত থাকতে হয় যে নীলাকে নিয়ে তার কুকুর ছানা কিনতে যাওয়ার সময় বের করতে বেশ বেগ পেতে হল। কুকুর ছানা কোথায় পাওয়া যায় সে সম্পর্কেও তার কোনো ধারণা নেই, আবিদ হাসান যখন ছোট ছিলেন তখন শীতের শুরুতে বেওয়ারিশ ছোট ছোট কুকুরের বাচ্চায় চারদিক ভরে উঠত। সেগুলো পোষা নিয়েও কোনো সমস্যা ছিল না। একবার তু তু করে ডাকলেই চিরদিনের জন্য ন্যাওটা হয়ে যেত। এখন দিনকাল পাল্টেছে, কুকুর ছানা কিনে আনতে হয়, ইনজেকশান দিতে হয়, ওষুধ খাওয়াতে হয়, মেজাজ–মর্জি বুঝে চলতে হয়। আবিদ হাসান অফিসে খোঁজ নিলেন এবং জানতে পারলেন কাটাবনের কাছে নাকি পোষা পশুপাখির দোকান রয়েছে। কাজেই একদিন সন্ধেবেলা নীলাকে নিয়ে তিনি কুকুরের বাচ্চা কিনতে গেলেন।