য়ুল হতচকিত হয়ে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি জান?
হ্যাঁ। তুমি আমার সঙ্গে ক্রসিয়াস গহপুঞ্জে ফিরে যেতে চাও না। তুমি এখানে থাকতে চাও। তাই না?
য়ুল কিছুক্ষণ বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে কীশের দিকে তাকিয়ে রইল, তারপর মাথা নেড়ে বলল, হ্যাঁ। তুমি ঠিকই আন্দাজ করেছ, আমি এখানে থাকতে চাই।
কীশ নরম গলায় বলল, আমি মানুষ নই, তাই মানুষকে বুঝতে পারি না, কিন্তু তাদের সাথে এত দীর্ঘ সময় কাটিয়েছি যে তারা কখন কী করবে অনেক সময় সেটা আন্দাজ করতে পারি।
য়ুল কিছু বলল না। কীশ ভাসমান যানের নিয়ন্ত্রণের কাছে দাঁড়িয়ে সেটা চালু করতে করতে বলল, আমি কাছাকাছি একটা ছোট দ্বীপ খুঁজে বের করেছি। সেখানে আমি তোমার জন্য একটা ছোট বাসস্থান তৈরি করেছি। পৃথিবীতে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজনীয় সবকিছু সেখানে আছে। জল–মানব আর জল–মানবীর শরীর থেকে কিছু জিনেটিক নমুনা সংগ্রহ করা আছে, সেটা ব্যবহার করে তোমার ফুসফুসের মাঝে পরিবর্তন আনা যাবে। কিন্তু সেটা সময়সাপেক্ষ ব্যাপার। যতদিন তুমি পানির নিচে থাকার মতো পুরোপুরি প্রস্তুত না হচ্ছ এই দ্বীপটিতে তোমাকে দীর্ঘ সময় কাটাতে হবে।
য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, কীশ–আমি তোমাকে কী বলে ধন্যবাদ জানাব বুঝতে পারছি না। কীশ শান্ত গলায় বলল, তুমি আর যেটাই কর আমাকে, ধন্যবাদ জানিও না। আমি যেটি করছি সেটি হচ্ছে তোমার জীবনের মূল্যকে পুরোপুরি উপেক্ষা করা। সেটি অমানবিক এবং অন্যায়। কিন্তু আমি সেটা করেছি তোমার জন্য–কারণ আমি জানি এটাই তোমার ইচ্ছে–
য়ুল বাধা দিয়ে বলল, কীশ, আমি তোমার প্রতি কৃতজ্ঞ।
কীশ য়ুলের দিকে তাকিয়ে বলল, তোমার কিংবা মানুষের প্রতি আমার এক ধরনের হিংসা হয়।
কেন?
কারণ যে তীব্র অনুভূতির জন্য তুমি তোমার নিজের জীবন বিপন্ন করে ফেলতে পার আমরা সেই অনুভূতি বুঝতে পারি না। কীশ কয়েক মুহূর্ত চুপ করে থেকে বলল, যাই হোক–য়ুল, পৃথিবীতে এখনো নানা ধরনের ব্যাক্টেরিয়া রয়েছে, সুপ্ত ভাইরাস রয়েছে, কাজেই তোমাকে সাবধান থাকতে হবে। তোমার চিকিৎসার ব্যবস্থা করে গেছি। নিরাপত্তার ব্যবস্থাও করে গেছি।
কীশ ভাসমান যানটিকে দ্বীপের মাঝামাঝি নামাতে নামাতে বলল, নিরাপত্তার জন্য আমি তোমার কাছে কিছু স্বয়ংক্রিয় অস্ত্র রেখে যাচ্ছি। তবে
তবে কী?
তুমি সেটা ব্যবহার করতে চাও কি না সেটি তোমার ইচ্ছে। কারণ জল–মানব এবং জল–মানবীরা যদি কখনো তোমাকে সত্যিকারের একটি অস্ত্র ব্যবহার করতে দেখে তারা তোমাকে ভুল বুঝতে পারে। তারা তোমাকে মনে করতে পারে কোনো অলৌকিক পুরুষ। স্বর্গের কোনো দেবতা। প্রচণ্ড ক্ষমতাধর কোনো জাদুকর।
তুমি ঠিকই বলেছ কীশ।
তবে তুমি তাদের জ্ঞান দিতে পার। নতুন জিনিস শেখাতে পার। যে জিনিস শিখতে তাদের কয়েক হাজার বছর লেগে যেত সেটা তুমি কয়েকদিনে শেখাতে পার। আমি তোমার জন্য গ্যালাক্টিক সাইক্লোপিডিয়া রেখে যাচ্ছি, কয়েকটা ক্রিস্টালে রাখা আছে। পৃথিবীর বা জ্ঞানবিজ্ঞানের সব তথ্য তুমি সেখানে পাবে।
ভাসমান যানটি নিচে নামাতে নামাতে কীশ বলল, মনে রেখো আজ থেকে কয়েক শতাব্দী আগে পৃথিবীর কিছু মানুষ অনেকগুলো শিশুকে জল–মানব আর জল–মানবীতে রূপান্তর করে সমুদ্রে নামিয়ে দিয়েছিল। তারা বাইরের কোনো সাহায্য ছাড়া বড় হয়েছে। তুমি তাদের মাঝে প্রথম একটি বড় পরিবর্তন আনতে যাচ্ছ। একটু ভুল করলে কিন্তু সব ওলটপালট হয়ে যাবে।
য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি ভুল করব না কীশ। আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি আমি কোনো ভুল করব না।
১০.
নভোযানটি প্রচণ্ড গর্জন করে আকাশের সাদা মেঘের মাঝে অদৃশ্য হয়ে যাওয়া পর্যন্ত য়ুল অপেক্ষা করল। তারপর সে দীর্ঘ পদক্ষেপে বালুবেলায় হেঁটে হেঁটে সমুদ্রের দিকে এগিয়ে যায়। সমুদ্রের ঢেউ সাদা ফেনা তুলে তার দিকে এগিয়ে পায়ের কাছে আছড়ে পড়ল। য়ুল তার মাঝে মাথা সোজা করে ঢেউ ভেঙে হেঁটে যেতে থাকে।
সমুদ্রের বালুবেলায় তার পায়ের চিহ্ন ঢেউ এসে মুছে দিতে থাকে।
ঠিক তার ফেলে আসা জীবনের মতোই।
ডক্টর ট্রিপল-এ
নীলা তার বাবাকে বলল, আব্বু আমাকে একটা কুকুর ছানা কিনে দেবে?
নীলার বাবা আবিদ হাসান অন্যমনস্কভাবে বললেন, দেব।
উত্তরটি শুনে নীলার সন্দেহ হল যে তার বাবা আসলে তার কথাটি ভালো করে শোনেন নি–সাধারণত শোনেন না। তাই ব্যাপারটি পরীক্ষা করে দেখার জন্য বলল, আব্বু আমাকে একটা হাতির বাচ্চা কিনে দেবে?
আবিদ হাসান তার কম্পিউটার স্ক্রিনের দিকে আরো একটু ঝুঁকে পড়ে বললেন, দেব।
নীলা এবারে গাল ফুলিয়ে বলল, আব্বু, তুমি আমার কোনো কথা শোন না।
আবিদ হাসান নীলার গলায় উত্তাপ লক্ষ করে এবারে সত্যি সত্যি তার দিকে মনোযোগ দিলেন। মুখে হাসি ফুটিয়ে বললেন, কে বলেছে শুনি না? এই যে শুনছি!
বল দেখি আমি কী বলেছি?
তুই বলেছিস তোকে একটা ইয়ে কিনে দিতে হবে।
কী কিনে দিতে হবে?
এই তো কিছু একটা হবে — বারো বছরের একটি মেয়ে কী চাইতে পারে ভেবে দেখার চেষ্টা করলেন এবং হঠাৎ করে আবিষ্কার করলেন সে সম্পর্কে তার জ্ঞান খুব সীমিত। ইতস্তত করে বললেন, টেডি বিয়ার?
নীলা এবারে সত্যি সত্যি রাগ করল, সে এখন আর বাচ্চা খুকি নয়, টেডি বিয়ারের বয়স অনেকদিন আগে পার হয়ে এসেছে কিন্তু তার নিজের বাবা এখনো সেটা জানে না। বাবার হাত ধরে ঝাঁকুনি দিয়ে বলল, টেডি বিয়ার না, কুকুর ছানা!।