সত্যি?
হ্যাঁ। যেরকম আমার আনন্দ হয়েছে সারা জীবনে আমার সেরকম আনন্দ হয় নি। কেন বলতে পারবে?
না। মানুষ খুব দুর্বোধ্য আমি তাদের বুঝতে পারি না।
য়ুল হেসে বলল, তুমি ঠিকই বলেছ। আমি মানুষ হয়েই মানুষকে বুঝতে পারি না, তুমি বায়োবট হয়ে কেমন করে বুঝবে? আমার আনন্দ হয়েছে কারণ এই জল–মানব আর জল–মানবীরা একেবারে শিশুর মতো সহজ–সরল। একটা ছোট শিশুকে দেখলে যে কারণে আনন্দ হয়, ওদের দেখলে সে কারণে আনন্দ হয়।
ও আচ্ছা।
য়ুল ভুরু কুঁচকে কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলেছি, ও আচ্ছা।
য়ুল একটু উষ্ণ হয়ে বলল, তুমি কেন ওটা বললে? তুমি কি আমার কথা বিশ্বাস করছ?
কীশ তরল গলায় বলল, তুমি যদি আমাকে সত্যি কথা বলতে বল তা হলে আমি বলব যে আমি তোমার কথা পুরোপুরি বিশ্বাস করছি না।
য়ুল গম্ভীর গলায় বলল, তা হলে কী কারণে আমার আনন্দ হয়েছে বলে তুমি মনে কর?
আমার ধারণা তিনা নামের মেয়েটির কারণে।
য়ুল থতমত খেয়ে গেল এবং জোর করে মুখে একটু কাঠিন্য এনে বলল, তুমি কী বললে?
আমি বলছি তিনা নামক মেয়েটির কারণে। মেয়েটি তোমার মুখে অক্সিজেন প্রবাহ করিয়ে বাঁচিয়ে দিয়েছিল বলে সম্ভবত তার প্রতি তোমার একটু কৃতজ্ঞতা জন্মেছে। এবারে তাকে দেখে সে জন্য তোমার নিশ্চয়ই আনন্দ হয়েছে। তা ছাড়া আরো একটি ব্যাপার
কী ব্যাপার?
মানুষের সৌন্দর্যের অনুভূতি আমি ঠিক বুঝতে পারি না। তবে আমার ধারণা মেয়েটি অপূর্ব রূপসী।
য়ুল কীশকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে বলল, বাজে কথা বোলো না কীশ। মানুষের অনুভূতি সম্পর্কে তোমার কোনো ধারণা নেই
কীশ মাথা নাড়ল, বলল, হতে পারে। আমি এসব ব্যাপারে একেবারেই অজ্ঞ। তবে আমি ভাসমান যানে বসে তোমার রক্তচাপ, হৃৎস্পন্দন এবং শরীরে নানা ধরনের হরমোনের পরিমাপ করছিলাম। আমি লক্ষ্য করেছি যতবার তুমি তিনা নামক জল–মানবীর কাছে গিয়েছ বা তার সাথে কথা বলেছ, তোমার রক্তচাপ এবং হৃৎস্পন্দন বেড়ে গেছে।
য়ুল খানিকক্ষণ কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, ও, তারপর সে হেঁটে জানালার কাছে। গিয়ে দাঁড়ায় নিজের কাছে গোপন করে লাভ নেই। তিনা নামের জল–মানবী মেয়েটির কথা সত্যিই ঘুরে–ফিরে তার মনে পড়ছে। কী আশ্চর্য!
০৮.
ভাসমান যানের পাশে য়ুল পা ঝুলিয়ে বসে নিশ্বাস নেবার তন্তুটি নিজের নাকে লাগিয়ে নেয়। যোগাযোগ মডিউলটি পরীক্ষা করে সমুদ্রে ঝাঁপিয়ে পড়ার আগে য়ুল কীশের দিকে তাকিয়ে বলল, আমি কিছুক্ষণের মাঝেই ফিরে আসব।
বেশ। কিন্তু
কিন্তু কী?
আমি এখনো বিশ্বাস করি তোমার দ্বিতীয়বার সমুদ্রের নিচে যাওয়াটি সঠিক সিদ্ধান্ত নয়। আমরা অল্প সময়ের মাঝে পৃথিবী ছেড়ে যাব, এই সময়টুকুতে আবার এ রকম ঝুঁকি নেওয়া ঠিক নয়।
ঝুঁকি? কিসের ঝুঁকি?
কত রকম ঝুঁকি। পৃথিবীর ওপরে প্রাণ প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে কিন্তু সমুদ্রের নিচে অসংখ্য প্রাণী রয়েছে। কিছু কিছু ভয়ঙ্কর। তুমি তাদের দেখে অভ্যস্ত নও।
সমুদ্রের নিচে যদি জল–মানব এবং জল–মানবী পুরো জীবন থাকতে পারে, আমি তা হলে এক ঘণ্টা থাকতে পারব।
সেটি সত্যি। কিন্তু
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই। আমি একজন মানব সন্তান। এই জল–মানব এবং জল–মানবীরাও মানব সন্তান। চিরদিনের মতো চলে যাবার আগে এক মানব সন্তানের অন্য মানব সন্তান থেকে বিদায় নেবার কথা।
সেটি সম্ভবত তুমি ঠিকই বলেছ। কিন্তু।
না, কোনো কিন্তু নেই। আমি তিনাকে বলেছিলাম তার কাছ থেকে বিদায় নেব। সে নিশ্চয়ই অপেক্ষা করছে।
কীশ কোনো কথা বলল না, সে জানে এখানে কথা বলার বিশেষ কিছু নেই।
য়ুল পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ার পর কীশ কিছুক্ষণ ভাসমান যানটিতে দাঁড়িয়ে থাকে। ভাসমান যানের মনিটরে সে য়ুলকে দেখতে পায়, জেট প্যাক ব্যবহার করে পানির গভীরে চলে যাচ্ছে। কীশ মনিটরটি স্পর্শ করে সেটি বন্ধ করে দিল। কয়েক ঘণ্টার মাঝে নভোযানটিকে পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে। তার আগেই তাকে অনেকগুলো কাজ শেষ করতে হবে। আশপাশে একটা নিরাপদ দ্বীপ খুঁজে বের করে সেখানে কিছু জরুরি আয়োজন শেষ করতে হবে। য়ুল ফিরে আসার আগে হয়তো শেষ করতে পারবে না–কিন্তু করার কিছু নেই।
০৯.
য়ুল ভেজা শরীরে ভাসমান যানটিতে বসে আছে। তার শরীর থেকে ফোঁটা ফোঁটা পানি পড়ে ভাসমান যানের কিছু যন্ত্রপাতি ভিজে যাচ্ছে কিন্তু সেদিকে য়ুলের নজর নেই। সে দীর্ঘসময় আকাশের দিকে তাকিয়ে থেকে একসময় মাথা নামিয়ে কীশের দিকে তাকাল। বলল, কীশ।
বল।
আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই। কিন্তু ঠিক কীভাবে বলব বুঝতে পারছি না।
কীশ মাথা ঘুরিয়ে য়ুলের দিকে তাকাল, তার সবুজাভ চোখে এক ধরনের আলোর ছটা জ্বলে উঠে আবার নিভে যায়।
য়ুল নিজের আঙুলের দিকে তাকাল এবং অনাবশ্যকভাবে নখের মাথা পরিষ্কার করতে করতে আবার কীশের দিকে তাকিয়ে একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি যেটা বলতে চাইছি সেটা কীভাবে শুরু করব বুঝতে পারছি না। তোমার কাছে সেটাকে অত্যন্ত বিচিত্র মনে হতে পারে
কীশ কোনো কথা না বলে ঝুলের দিকে তাকাল এবং হঠাৎ য়ুল কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেল।
কীশ এবারে সোজা হয়ে দাঁড়াল এবং নিজের আধা জৈবিক আধা যান্ত্রিক হাত দিয়ে য়ুলের কাধ স্পর্শ করে বলল, য়ুল তুমি কী বলতে চাইছ আমি জানি।