আমার ঘুম ভাঙল একটি মৃদু শব্দে। শব্দটি কী আমি ধরতে পারলাম না কিন্তু হঠাৎ করে আমি পুরোপুরি জেগে উঠলাম। আমি নিঃশব্দে শুয়ে থেকে ঘরের মাঝখানে তাকাই, কোয়ার্টজের জানালা দিয়ে ঘরে নক্ষত্রের একটা ক্ষীণ আলো এসে ঢুকেছে তার মাঝে আবছা দেখা যাচ্ছে ঘরের মাঝখানে একটা ছায়ামূর্তি দাঁড়িয়ে আছে। ছায়ামূর্তিটি এক পা এগিয়ে এল, সাথে সাথে পা ফেলার এক ধরনের ধাতব শব্দ শুনতে পেলাম। এটি একটি রবোট। যেহেতু আমাকে খুঁজে এই ঘরে এসে ঢুকেছে নিশ্চয়ই এটি একটি অনুসন্ধানী রবোট, গ্রুস্টান পাঠিয়েছে আমাকে গুলি করে শেষ করার জন্যে। নিশ্চয়ই রবোটটির হাতে রয়েছে এটমিক ব্লাস্টার। নিশ্চয়ই সেটা এখন আমার দিকে তাক করে রয়েছে, অন্ধকারে আমি দেখতে পাচ্ছি। না। প্রচণ্ড আতঙ্কে আমার হৃৎস্পন্দন দ্রুততর হয়ে ওঠে–কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম জমে উঠতে থাকে।
আমি অন্ধকারে আবছা ছায়ামূর্তিটির দিকে তাকিয়ে রইলাম, ছায়ামূর্তিটি আরো এক পা এগিয়ে এল। হঠাৎ করে তার কপাল থেকে এক ঝলক আলো বের হয়ে আসে, প্রখর আলোতে আমার চোখ ধাধিয়ে যায়, আমি হাত দিয়ে আমার চোখ আড়াল করার চেষ্টা করলাম। রবোটটি আরো এক পা এগিয়ে এল, আমাকে হত্যা করার জন্যে তার এত কাছে আসার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।
মহামান্য কুশান।
আমি হঠাৎ ভয়ানক চমকে উঠলাম, লাফিয়ে উঠে বসে জিজ্ঞেস করলাম, কে?
আমি ক্রিশি।
ক্রিশি! আমি আনন্দে চিৎকার করে লাফিয়ে নেমে এসে ক্রিশিকে জড়িয়ে ধরলাম, মনে হল হঠাৎ করে আমি বুঝি আমার হারিয়ে যাওয়া কোনো আপনজনকে খুঁজে পেয়েছি!
ক্রিশি আমার আলিঙ্গন থেকে নিজেকে মুক্ত করার চেষ্টা করে বলল, মহামান্য কুশান, আপনি নিশ্চয়ই জানেন আমি মানুষের অর্থহীন মানবিক উচ্ছ্বাস অনুভব করতে পারি না।
জানি ক্রিশি। জানি। তুমি সেটা নিয়ে মাথা ঘামিও না। তোমাকে দেখে আমার খুব ভালো লাগছে, আমি ভাবছিলাম তুমি বুঝি কোনো অনুসন্ধানী রবোট, আমাকে মারার জন্যে এসেছ!
আমি আপনাকে মারার জন্যে আসি নি। ক্রিশি মাথা নেড়ে বলল, আপনাকে আমি কখনোই হত্যা করব না।
শুনে খুব খুশি হলাম! এখন বল তুমি কেমন করে আমাকে খুঁজে পেয়েছ?
ব্যাপারটি কঠিন নয়। আমি জানতাম আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন।
কেমন করে জানতে?
আপনাকে আমি দক্ষিণের বাতাস নিয়ে একদিন গান গাইতে শুনেছি। আমার বিবেচনায় সেটি উচ্চ শ্রেণীর সঙ্গীত নয় কিন্তু নিঃসন্দেহে সেটি আপনার আন্তরিক প্রচেষ্টা
ভণিতা রেখে আসল কথাটি বল
কাজেই আমি ধরে নিয়েছি আপনি দক্ষিণ দিকে যাবেন। আপনি তাড়াতাড়ি এক শ কিলোমিটার সরে যাবার জন্যে চেষ্টা করবেন সোজা যেতে এবং সূর্যকে ব্যবহার করে আপনার দিক ঠিক করবেন–কাজেই আপনার গতিপথ হবে ত্রুটিপূর্ণ। আমি তাই সম্ভাব্য ত্রুটিপূর্ণ পথগুলোতে হেঁটে হেঁটে আপনাকে খুঁজেছি। বিস্ফোরক ফ্যাক্টরির গেটে আটকা পড়া একটি রবোট আমাকে সাহায্য করেছে–
ওই মূর্খ রবোটটা? যে পরিচয়পত্র চাইছে?
হ্যাঁ, কিন্তু সে মূর্খ নয়। বিস্ফোরকের মূল উপাদান সম্পর্কে তার গভীর জ্ঞান রয়েছে।
রবোটের জ্ঞানের পরিধি নিয়ে এই গভীর রাতে আমি ক্রিশির সাথে তর্ক করতে রাজি নই। আমি প্রসঙ্গ পাল্টে জিজ্ঞেস করলাম, ক্রিশি, আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা কতটুকু?
দশমিক শূন্য শূন্য তিন।
সেটা কতটুকু?
তুলনা করার জন্যে বলা যায় একটি উঁচু বিল্ডিং থেকে নিচে ঝাঁপিয়ে পড়লে বেঁচে থাকার সম্ভাবনা দশমিক শূন্য শূন্য দুই।
হুম। আমি অকারণে বাম গার্লটি নির্মমভাবে চুলকাতে চুলকাতে বললাম, তার মানে আমার বেঁচে থাকার সম্ভাবনা বেশি নয়।
না, মহামান্য কুশান।
আমি যদি মরে যাই তখন তুমি কী করবে?
আপনার মৃতদেহ যথাযযাগ্য মর্যাদার সাথে সমাহিত করব।
সেটা কী রকম?
ক্রোমিয়ামের একটা বাক্সে করে মাটির নিচে রেখে দেব। উপরে একটা প্রস্তর ফলকে লিখব–এখানে কুশান কিশুনুক চিরনিদ্রায় শায়িত।
আমি তোমার কথা শুনে অভিভূত হয়ে গেলাম, ক্রিশি
আপনি কি আরো কিছু চান?
না। আমি একটু হেসে বললাম, তারপর তুমি কী করবে?
আমি আমার পারমাণবিক ব্যাটারির যোগাযোগ ছিন্ন করে নিজেকে অচল করে দেব।
ব্যাপারটি এই ধরনের নিম্নশ্রেণীর রবোটের কপোট্রনে প্রোগ্রামিঙের অংশ কিন্তু তবু আমি একটু অভিভূত হয়ে পড়ি। সারা পৃথিবীতে অন্তত একটি বস্তু রয়েছে যেটা আমার জন্যে যথেষ্ট অনুভব করে। আমি খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বললাম, ক্রিশি, তুমি যখন এসেছ আমাকে সাহায্য করতে পারবে।
অবশ্যি মহামান্য কুশান। আমি আপনার জন্যে কী করতে পারি?
প্রথমে দরকার খাবার এবং পানীয়।
আপনি নিশ্চয়ই যে খাবার মুখে দিয়ে খাওয়া হয় সেই খাবারের কথা বলছেন, সরাসরি ধমনীতে যে খাবার দেয়া হয় সেই খাবার নয়?
না, আমি সেরকম খাবারের কথা বলছি না। আমি মুখে দিয়ে খাবারের কথা বলছি।
আমি সেরকম খাবার খুঁজে বের করব। আপনাকে খুঁজে বের করার সময় আমি খাবার প্রস্তুত করার একটা ফ্যাক্টরি দেখেছি। ভেঙেচুরে গেছে কিন্তু ভিতরে হয়তো খাবার পাওয়া যাবে।
চমৎকার! আর পানীয়?
সেটা নিয়ে সমস্যা হতে পারে। আমি কোনো পানীয় প্রস্তুতকারী ফ্যাক্টরি দেখি নি।
খুঁজে বের করতে হবে, যেভাবে সম্ভব খুঁজে বের করতে হবে।