আমি দীর্ঘ সময় সেখানে পা ছড়িয়ে বসে রইলাম। ধীরে ধীরে ভোরের আলো ফুটে উঠেছে। যেখানে বসে আছি জায়গাটি একটি কারখানার ধ্বংসস্তূপ। কিসের কারখানা কে জানে। বড় বড় লোহার সিলিন্ডার ভেঙে পড়ে আছে। পিছনে রং ওঠা বিবর্ণ দেয়াল, তার মাঝে থেকে কঙ্কালের মতো ধাতব বিম বের হয়ে এসেছে। মরচে ধরা বিবর্ণ যন্ত্রপাতি। ধুলায় ধূসর। এক পাশে বড় একটি ঘর, ছাদ ভেঙে পড়ে আছে। অন্য পাশে কংক্রিটের দেয়াল আগুনে পুড়ে কালো হয়ে আছে। সব মিলিয়ে সমস্ত এলাকাটিতে একটি মন খারাপ করা দৃশ্য। সমস্ত পৃথিবী এখন এ রকম অসংখ্য ছোট ছোট মন খারাপ করা দৃশ্যের একটি মোজাইক। মানুষ কেমন করে এ রকম একটি কাজ করতে পারল?
আমি পায়ের কাছে রাখা ব্যাগটি টেনে এনে খুলে ভিতরে তাকালাম। একটি গরম কাপড় এবং কিছু খাবার ও পানীয়। ছোট একটি শিশিতে কিছু ওষুধ। একটা ছোট চাকু এবং সৌর ব্যাটারিসহ একটা ছোট ল্যাম্প। আমি খাবারগুলো থেকে বেছে বেছে ছোট চতুষ্কোণ এক টুকরা খাবার বেছে নিয়ে সেটা চিবোতে থাকি। বিস্বাদ খাবার খেতে কষ্ট হয় কিন্তু আমি জানি জোর করে খেতে পারলে সাথে সাথে শরীরে শক্তি ফিরে পাব। সত্যি তাই, একটু পরেই আমার ক্লান্তি কেটে যায়, আমি শক্তি অনুভব করতে থাকি। শরীরের অবসাদ ঝেড়ে ফেলে আমি উঠে দাঁড়ালাম। কেন জানি না ফ্যাক্টরিটা একটু ঘুরে দেখার ইচ্ছে হল। এক পাশে যেতেই হঠাৎ একটা শব্দ শুনে আমি থমকে দাঁড়ালাম। কিসের শব্দ এটা? পারমাণবিক বিস্ফোরণে কোনো প্রাণী বেঁচে গিয়েছে?
আবার হল শব্দটি। কিছু একটা নড়ছে। আমি কৌতূহলী হয়ে সাবধানে এগিয়ে গেলাম। ফ্যাক্টরির বড় গেটটি এখনো দাঁড়িয়ে আছে, তার পাশ দিয়ে ঢুকতেই চোখে পড়ল একটা বড় লোহার বিমের নিচে একটা রবোট চাপা পড়ে আছে। একটু পরে পরেই সেটা হাত নাড়ছে, চোখ ঘোরাচ্ছে, মাথা ঝাঁকাচ্ছে। অত্যন্ত নিচু শ্রেণীর রবোট, বুদ্ধিবৃত্তি প্রায় জড় পদার্থের মতো। রবোটটি মাথা ঘুরিয়ে আমাকে দেখে হাত নাড়িয়ে বলল, ভেতরে ঢোকার জন্যে পরিচয়পত্র দেখাতে হবে। আপনার পরিচয়পত্র জনাব–
মূর্খ রবোটটি এখনো জানে না সমস্ত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে গেছে প্রায় দুই যুগ আগে!
আমি আবার হাঁটতে থাকি। শুনতে পেলাম পিছন থেকে সেটি আবার বলল, আপনার পরিচয়পত্র জনাব। আপনার পরিচয়পত্র?
.
কিছুক্ষণের মাঝেই চারদিক অত্যন্ত উত্তপ্ত হয়ে ওঠে। ধ্বংসস্তূপ ধাতব জঞ্জাল সূর্যের প্রখর আলোতে যেন ধিকিধিকি করে জলছে। আমার নিশ্বাস নিতে কষ্ট হয় তার মাঝে আমি পা টেনে টেনে হাঁটতে থাকি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব যত দূরে সরে যেতে হবে।
ঘণ্টা তিনেক পরে আমি আকাশের দিকে তাকালাম। সূর্য প্রায় মাথার উপরে উঠে গেছে। সম্ভবত এখন আমার ছায়ায় বসে বিশ্রাম নেয়া উচিত, কিন্তু আমার সাহস হল না। গ্রুস্টান যদি এক ডজন অনুসন্ধানী রবোট আমার পিছনে লেলিয়ে দেয় আমাকে খুঁজে বের করতে খুব বেশি সময় লাগার কথা নয়। যেভাবে সম্ভব আমাকে এক শ কিলোমিটার দূরে। চলে যেতে হবে। ঘণ্টায় আমি যদি ছয় থেকে সাত কিলোমিটার হাঁটতে পারি তাহলে। কমপক্ষে পনের ঘণ্টা একটানা হেঁটে যেতে হবে। সব মিলিয়ে অনেক দূর বাকি। একটা বাই ভার্বাল হলে চমৎকার হত কিংবা একটা শক্তিশালী ভারবাহী রবোট। এক সময়ে এই ব্যাপারটি কী সহজই না ছিল আর এখন সেটি কী ভয়ঙ্কর কঠিন!
আমি জোর করে আমার মস্তিষ্ক থেকে সবকিছু সরিয়ে ফেলি। এখন আর কোনো চিন্তা নয়, ভাবনা নয়, সমস্ত চেতনায় এখন শুধু একটি ব্যাপার, আমাকে সরে যেতে হবে। দূরে সরে যেতে হবে। যত দূর সম্ভব। যেভাবে সম্ভব।
সারাদিন আমি বিচিত্র সব এলাকার মাঝ দিয়ে হেঁটে গেলাম। কখনো এ রকম এলাকার মাঝে আমি একা একা হেঁটে যাব কল্পনা করি নি। দীর্ঘ সময়ে কোনো লোকালয় বা বসতি দূরে থাকুক একটি ছোট জীবিত প্রাণীও চোখে পড়ে নি। একটি ধসে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রে কিছু সশস্ত্র রবোটের দেখা পেয়েছিলাম, তারা সেই ধ্বংস হয়ে যাওয়া যোগাযোগ কেন্দ্রটিকে পাহারা দিচ্ছে। আমি খুব সাবধানে তাদের এড়িয়ে গেলাম, কপোট্রনে কী নির্দেশ দেয়া আছে জানি না, দেখামাত্র আমাকে গুলি করে দিতে পারে। একটি গুদামঘরের কাছে আরো কয়েকটি রবোট দেখতে পেলাম, মনে হল তাদের কপোট্রনে খুব বড় ধরনের বিভ্রান্তি। বিশাল একটি লোহার রড নিয়ে তারা মহা আনন্দে একে অন্যকে আঘাত করে যাচ্ছে। আমি তাদেরকেও সাবধানে পাশ কাটিয়ে গেলাম।
বেলা ডুবে যাবার পর আমি আবিষ্কার করলাম আমার গায়ে আর বিন্দুমাত্র জোর অবশিষ্ট নেই। আমার এখন বিশ্রাম নেয়া দরকার। অন্ধকার গভীর হয়ে গেলে আমি সম্ভবত আশ্রয় নেবার ভালো জায়গা খুঁজে পাব না। আমি আশপাশে তাকিয়ে একটি বড় দালান খুঁজে পেলাম। উপরের অংশটুকু ধ্বংস হয়ে গেছে কিন্তু নিচের কয়েকটি তালা মনে হয় এখনো অক্ষত আছে। দরজাগুলো ভিতর থেকে বন্ধ, খুলতে পারলাম না, একটি জানালা ভেঙে ভিতরে ঢুকতে হল। বাইরে সবকিছু ধুলায় ধূসর কিন্তু ভিতরে মোটামুটি পরিষ্কার। একটা টেবিল ঠেলে কোয়ার্টজের একটা জানালার নিচে নিয়ে এলাম, রাতে যদি বিষাক্ত বৃশ্চিক বের হয়ে আসে টেবিলের উপরে উঠতে পারবে না। অসম্ভব খিদে পেয়েছে, ব্যাগ খুলে এক টুকরা খাবার মুখে দেব দেব করেও দিতে পারলাম না, পানীয়ের বোতল থেকে এক ঢোক পানীয় খেয়ে টেবিলটিতে লম্বা হয়ে শুয়ে পড়লাম। পানীয়টাতে কী আছে জানি না কিন্তু অনুভব করি সারা শরীরে একটা সতেজ ভাব ছড়িয়ে পড়ছে। আমি চোখ বন্ধ করে প্রায় সাথে সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।