আমি হতচকিতের মতো তাকিয়ে থাকি। আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? মৃত্যুদণ্ড? একটি কম্পিউটার প্রোগ্রামকে কম্পিউটার প্রোগ্রাম বলার জন্যে আমাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে? হঠাৎ করে ভয়ঙ্কর আতঙ্কে আমার সমস্ত শরীর শিউরে ওঠে।
লিয়ানা আমার চোখের দিকে তাকিয়ে বলল, বাইরের পৃথিবী খুব ভয়ঙ্কর, কোনো মানুষ সম্ভবত বেঁচে থাকতে পারবে না। তোমাকে হাইড্রোজেন সায়নাইড না দিয়ে তাই বাইরে পাঠানো হচ্ছে। গ্রুস্টান সম্ভবত এটা পছন্দ করবে না, কিন্তু আমি নিজের দায়িত্বে এই ঝুঁকি নিচ্ছি।
আমি শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকি, কিছুই আর বুঝতে পারছি না, কিছুই আর শুনতে পাচ্ছি না।
ক্ৰকো গলা নামিয়ে বলল, রাত্রি শেষ হবার আগে তোমাকে চলে যেতে হবে কুশান।
আমি উঠে দাঁড়ালাম। হঠাৎ বুকের ভিতর ভয়ঙ্কর এক ধরনের ক্রোধ অনুভব করি। কার উপর এই ক্রোধ? অসহায় মানুষের উপর নাকি কূটকৌশলী হৃদয়হীন কোনো যন্ত্রের উপর? ইচ্ছে করছিল চারপাশের সবকিছু ধ্বংস করে দেই। অনেক কষ্টে নিজেকে শান্ত করে বললাম, ঠিক আছে। আমি যাচ্ছি।
দরজার কাছে তোমার জন্যে একটা ব্যাগ রাখা আছে। সেখানে তোমার জন্যে প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র দেয়া হয়েছে।
কোনো অস্ত্র? এটমিক ব্লাষ্টার?
না। কোনো অস্ত্র নেই।
আমি কি একটি বাই ডার্বাল নিতে পারি?
আমি দুঃখিত তোমাকে আর কিছু দেয়া সম্ভব নয়।
আমি কি আমার বন্ধুদের কাছ থেকে বিদায় নিতে পারি?
লিয়ানা শান্ত গলায় বলল, সেটা জটিলতা আরো বাড়িয়ে দেবে।
আমার একটা রবোট রয়েছে। ক্রিশি। তার কাছে বিদায় নিতে পারি?
ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট। তার কাছে বিদায় নেয়ার সত্যি কোনো প্রয়োজন নেই।
আমি অনুনয় করে কিছু একটা বলতে গিয়ে থেমে গেলাম। কার কাছে আমি অনুনয় করব? এই মানুষগুলো বিশাল একটি শক্তির হাতের পুতুল। তার বিরুদ্ধে যাবার এদের কোনো ক্ষমতা নেই।
লিয়ানা নরম গলায় বলল, বিদায় কুশান।
বিদায়।
তোমাকে অন্তত এক শ কিলোমিটার দূরে চলে যেতে হবে। এর ভিতরে তোমাকে পাওয়া গেলে প্রতিরক্ষা রবোটদের গুলি করার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আমি লিয়ানার দিকে তাকালাম, কোনো এক দুর্বোধ্য কারণে হঠাৎ আমার মুখে একটু হাসি ফুটে ওঠে। লিয়ানা কেন জানি আমার হাসিটুকু সহ্য করতে পারল না, হঠাৎ করে আমার উপর থেকে দৃষ্টি সরিয়ে নিচের দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আর কোনোদিকে না তাকিয়ে হেঁটে বের হয়ে আসি। দরজার কাছে রাখা ব্যাগটা। নেব কি না ঠিক বুঝতে পারছিলাম না, শেষ মুহূর্তে তুলে নিলাম। লিয়ানার ঘরের বাইরে অনেকে দাঁড়িয়েছিল, আমাকে দেখে কৌতূহলী মুখে আমার দিকে তাকাল কিন্তু কেউ কিছু বলল না। আমি তাদের দিকে না তাকিয়ে রাস্তায় এসে দাঁড়ালাম।
একবার পিছনে তাকিয়ে আমি সোজা সামনে হেঁটে যেতে থাকি। বড় হলঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে আমি ভাঙা ফ্যাক্টরির কাছে এসে দাঁড়াই। সামনে একটি বিপজ্জনক ভাঙা ব্রিজ, সাবধানে সেটার উপর দিয়ে হেঁটে আমি আমাদের বসতির বাইরে পৌঁছালাম।
সামনে আদিগন্ত বিস্তৃত বিশাল ধ্বংসস্তূপ। ক্রোমিয়ামের ধসে পড়া দেয়াল, বিবর্ণ রং ওঠা জঞ্জাল, কালো কংক্রিট–এক বিশাল জনমানবশূন্য অরণ্য। যার কোনো শুরু নেই, যার কোনো শেষ নেই।
এই বিশাল অরণ্যে আজ থেকে আমি একা।
০৩. ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত
ভোরের আলো না ফোঁটা পর্যন্ত আমি দক্ষিণ দিকে হেঁটে গেলাম। কেন দক্ষিণ দিকে সেটা আমি নিজেও জানি না, কিন্তু প্রতিদিন সন্ধেবেলা আমি যখন ক্রোমিয়াম দেয়ালে হেলান দিয়ে সূর্যকে অস্ত যেতে দেখেছি তখন হঠাৎ হঠাৎ অনুভব করেছি দক্ষিণ দিক থেকে একটা কোমল বাতাস বইছে–হঠাৎ করে আমার শরীর জুড়িয়ে এসেছে। হয়তো দক্ষিণ দিকে সুন্দর কিছু আছে, কোমল কিছু আছে, আমি নিশ্চিত নই, কিন্তু আমার বিশ্বাস করতে ইচ্ছে করে।
আমি পাথুরে রাস্তায় পা টেনে টেনে হাঁটছি। ভোরের কনকনে ঠাণ্ডা বাতাস, মনে হচ্ছে একেবারে হাড়ের ভিতরে একটা কাঁপুনি শুরু করে দিয়েছে। কে জানে আমাকে যে ব্যাগটি দিয়েছে তার মাঝে কোনো গরম কাপড় আছে কি না–কিন্তু এই মুহূর্তে আমার সেটা খুলে দেখার ইচ্ছে করছে না। কনকনে শীতে দুই হাত ঘষে ঘষে শরীরকে উষ্ণ রাখার চেষ্টা করতে করতে আমি মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকি। আমি একটা ঘোরের মাঝে আছি, আমার কী হবে আমি জানি না। এই মুহূর্তে আমার মস্তিষ্ক সেটা নিয়ে ভাবতেও চাইছে না–যতদূর সম্ভব দূরে সরে যাওয়া ছাড়া আর কিছুতেই মনোযোগ কেন্দ্রীভূত করতে পারছি না। এক শ কিলোমিটার দূরত্ব বলতে কতটুকু দূরত্ব বোঝানো হয় আমি জানি। কিন্তু অন্ধকারে, একটি ধ্বংসস্তূপে আচ্ছন্নের মতো হেঁটে হেঁটে সেই দূরত্ব অতিক্রম করতে কত সময় লাগবে আমি জানি না। আমি এই মুহূর্তে কিছু ভাবতেও চাই না, কিছু জানতেও চাই না, শুধু দুঃস্বপ্নের মতো একটা ঘোরের মাঝে শরীর টেনে টেনে হেঁটে যেতে চাই। ক্লান্তিতে দেহ অবসন্ন হয়ে আসছে, পা আর চলতে চায় না, মাথা ভারি, চোখ জ্বালা করছে, মুখে একটা বিস্বাদ অনুভূতি কিন্তু আমি তবু থামলাম না, মাথা নিচু করে সামনে হেঁটে যেতে থাকলাম।
যখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠল আমি আর হেঁটে যেতে পারলাম না, বড় একটা কংক্রিটে হেলান দিয়ে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। ক্লান্তিতে আমার সমস্ত শরীর অবসন্ন হয়ে এসেছে। পায়ের কাছে ব্যাগটা রেখে আমি মাথা হেলান দিয়ে বসে চোখ বন্ধ করি। সবকিছু কী অর্থহীন মনে হতে থাকে। কেন আমি এভাবে ছুটে যাচ্ছি? কোথায় ছুটে যাচ্ছি?