সবচেয়ে প্রথম কথা বলল বৃদ্ধ ক্লাউস। মাথার সাদা চুল পিছনে সরিয়ে সে কাঁপা গলায় বলল, গ্রুস্টানের উপস্থিতি একটি অবিশ্বাস্য ব্যাপার। অভূতপূর্ব অভিজ্ঞতা। মনপ্রাণের সব ধরনের অবসাদ কেটে গিয়ে এক ধরনের সতেজ ভাব এসে যায়।
কমবয়সী রিশি বলল, সমস্ত শরীর শিউরে শিউরে ওঠে! সে তার হাতটি সামনে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, এই দেখ এখনো আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠছে।
ক্লাউস আবার বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য আমরা গ্রুস্টানের স্নেহধন্য হয়েছি। তার ভালবাসা পেয়েছি।
ক্লাউসের চোখ জ্বলজ্বল করতে থাকে, সে হঠাৎ দুই হাত উপরে তুলে উচ্চৈঃস্বরে চিৎকার করে ওঠে, জয় হোক। রুস্টানের জয় হোক।
ঘরের অনেকে তার সাথে যোগ দিয়ে বলল, জয় হোক।
ঠিক তখন হেঁটে হেঁটে লিয়ানা কাছে এসে দাঁড়াল, তাকে একই সাথে ক্লান্ত এবং বিষণ দেখাচ্ছে। ক্লাউস লিয়ানার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলল, আমাদের কত বড় সৌভাগ্য গ্রুস্টান আমাদের এত স্নেহ করে।
লিয়ানা কিছু বলল না। ক্লাউস আবার বলল, গ্রুস্টানের সাথে সময় কাটালে মনপ্রাণ পবিত্র হয়ে যায়।
আমার কী হল জানি না হঠাৎ করে বলে ফেললাম, কিন্তু গ্রুস্টান তো একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম ছাড়া আর কিছু না!
ঘরের ভিতরে হঠাৎ যেন একটা বজ্রপাত ঘটে গেল। যে যেখানে ছিল সেখানে পাথরের মতো স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে যায়। কারো মুখে কোনো কথা নেই। সবাই বিস্ফারিত চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। আমি ঘুরে সবার দিকে তাকালাম, হঠাৎ করে কেমন জানি এক ধরনের আতঙ্ক অনুভব করতে থাকি।
লিয়ানা খুব ধীরে ধীরে ঘুরে আমার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল, তুমি কী বলেছ কুশান?
আমি আবার মাথা ঘুরিয়ে সবার দিকে তাকালাম, কারো মুখে কোনো কথা নেই, সবাই স্থির চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। লিয়ানা আবার বলল, কুশান–
বল।
তুমি কী বলেছ?
আমি–আমি হঠাৎ প্রায় মরিয়া হয়ে বলে ফেললাম, আমি বলেছি যে গ্রুস্টান একটা কম্পিউটার প্রোগ্রাম। রিকিভ ভাষায় লেখা একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। মানুষের সাথে তার যোগাযোগ হয় হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে। ত্রিমাত্রিক ছবিতে। সে একটি কৃত্রিম চরিত্র। সে সত্যিকারের কিছু নয়–
লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, সত্যিকারের বলতে তুমি কী বোঝাও? ঈশ্বর ধরাছোঁয়ার অনুভবের বাইরে ছিল তবুও কি পৃথিবীর মানুষ হাজার হাজার বছর ঈশ্বরকে বিশ্বাস করে নি?
আমি কী বলব বুঝতে পারলাম না। লিয়ানা মাথা নেড়ে বলল, সবকিছুর একটা সময় আছে কুশান। উৎসবের সময় আছে, শোকেরও সময় আছে। বিপ্লবের সময় আছে, বিদ্রোহেরও সময় আছে। সময়ের আগে কিছু করতে চাইলে অনেক বড় ঝুঁকি নিতে হয়। আমাদের মানুষের এখন সেই ঝুঁকি নেয়ার শক্তি নেই কুশান।
আমি অবাক হয়ে লিয়ানার দিকে তাকালাম, তাকে হঠাৎ কী দুঃখী একটা মানুষের মতো মনে হচ্ছে। আমার হঠাৎ ইচ্ছে হল তার মুখ স্পর্শ করে বলি, না লিয়ানা তুমি ভুল বলছ। আমাদের মানুষের সেই শক্তি আছে। কিন্তু আমি কিছু বলতে পারলাম না।
লিয়ানা খানিকক্ষণ চুপ করে থেকে বলল, একটা পাহাড়ের উপর থেকে তুমি একটা পাথর গড়িয়ে দিয়েছ কুশান। নিচে পড়তে পড়তে পাথরটা ভেঙে টুকরা টুকরা হয়ে যেতে পারে আবার গতি সঞ্চয় করে অন্য পাথরকে স্থানচ্যুত করে বিশাল একটা ধস নামিয়ে দিতে পারে। কোনটা হবে আমি জানি না। লিয়ানা একটা নিশ্বাস নিয়ে বলল, আমি কিন্তু এখন কোনোটাই চাই নি।
আমি তখনো কিছু বলতে পারলাম না। লিয়ানা খানিকক্ষণ নিষ্পলক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে এক ধরনের বিষণ্ণ গলায় বলল, তুমি নিশ্চয়ই জান গ্রুস্টান আমাদের এই কথোপকথনটি শুনছে।
আমি জানতাম তবু কেন জানি একবার শিউরে উঠলাম।
০২. গভীর রাতে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল
গভীর রাতে হঠাৎ আমার ঘুম ভেঙে গেল, কেউ একজন আমার কপালে হাত রেখেছে। শীতল ধাতব হাত, নিশ্চয়ই নিচু শ্রেণীর একটা প্রতিরক্ষা রবোট। আমি চোখ খুলতেই দেখতে পেলাম একজোড়া সবুজ ফটোসেলের চোখ আমার উপর স্থির হয়ে আছে। আমি কাঁপা গলায় বললাম, কে?
আমি মহামান্য কুশান। কিউ–৪৩। একজন প্রতিরক্ষা রবোট।
কী চাও তুমি?
আমি আপনাকে নিতে এসেছি।
নিতে এসেছ?
হ্যাঁ, মহামান্য কুশান।
কোথায়? সর্বোচ্চ কাউন্সিলের অধিবেশনে।
এত রাতে?
হ্যাঁ মহামান্য কুশান, জরুরি অধিবেশন।
আমি বিছানায় উঠে বসে বললাম, আমি যেতে চাই না, কিউ—৪৩।
আপনি নিজে থেকে যেতে না চাইলে জোর করে নিয়ে যাওয়ার আদেশ রয়েছে মহামান্য কুশান।
ও। আমি বিছানা থেকে নিচে নেমে দাঁড়ালাম। সামনের স্বচ্ছ দেয়ালে আমি নিজের প্রতিবিম্বটি দেখতে পেলাম, চেহারায় এক ধরনের বিপর্যস্ততার ছাপ। আমি মেঝে থেকে একটা পোশাক তুলে শরীরের উপর জড়িয়ে নিতে থাকি, ঠিক তখন ক্রিশি আমার পাশে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, এটি জরুরি অধিবেশনের উপযোগী পোশাক নয়।
আমি একটু অধৈর্য হয়ে বললাম, কী বলছ তুমি ক্রিশি?
আপনার আরেকটু শোভন পোশাক পরে যাওয়া দরকার।
এই মাঝরাতে তুমি আমাকে জ্বালাতন করছ ক্রিশি।
ক্রিশি আমার অনুযোগে কোনো গুরুত্ব না দিয়ে ধীর পায়ে পাশের ঘরে হেঁটে চলে গিয়ে আমার জন্যে একটি পোশাক নিয়ে আসে। এ ধরনের পোশাকে আমাকে খানিকটা আহাম্মকের মতো দেখাবে জেনেও আমি আর আপত্তি করলাম না। ক্রিশি অত্যন্ত নিম্ন শ্রেণীর রবোট, তার সাথে কোনকিছু নিয়ে তর্ক করা একরকম দুঃসাধ্য ব্যাপার।