নিরাপত্তা! আশ্চর্য নিরাপত্তা!
শুধু তাই নয়– গ্রুস্টানের মুখ হঠাৎ হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে, পৃথিবীর অপর প্রান্তের এক ল্যাবরেটরিতে রয়েছে অপূর্ব সব সফটওয়ার। তাদের উৎকর্ষের কোনো তুলনা নেই। মহান শিল্পকর্মের মতো হবে তার আবেদন। আমি সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে দেব এই মহান সৃষ্টি। তোমাদের জীবন হবে অপূর্ব আনন্দময়
আনন্দময়! অপূর্ব আনন্দময়!
গ্রুস্টানের গলার স্বর আবেগে কাঁপতে থাকে। তার সুরেলা কণ্ঠস্বরে সারা ঘরে এক ধরনের উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে। পৃথিবীর নূতন মানুষ নিয়ে সে নূতন জীবনের কথা বলে, নূতন স্বপ্নের কথা শোনায়। আমাদের বুকে নূতন এক ধরনের আশা জাগিয়ে তোলে। তার গলার স্বর, কথা বলার ভঙ্গি, গভীর আবেগ আমাদের মন্ত্রমুগ্ধের মতো করে রাখে। আমাদের শরীর শিহরিত হয়ে উঠতে থাকে, আমরা এক ধরনের রোমাঞ্চ অনুভব করতে থাকি। আমরা যেন একটি স্বপ্নের জগতে চলে যাই।
এক সময় গ্রুস্টানের কথা শেষ হল, আমরা স্তব্ধ হয়ে বসে রইলাম। বুকের ভিতর তখনো কেমন যেন শিহরন।
লিয়ানা মাথা নিচু করে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান।
বল লিয়ানা।
আমরা আমাদের এই বসতিতে আমাদের শিশুদের শিক্ষা দিতে চাই। প্রস্তুত করতে চাই নূতন জীবনের জন্যে।
অবশ্যি লিয়ানা। অবশ্যি শিক্ষা দেবে তোমাদের শিশুদের।
আমরা আপনার সাহায্য চাই মহামান্য গ্রুস্টান
অবশ্যি আমার সাহায্য তোমরা পাবে লিয়ানা। অবশ্যি পাবে। আমি তোমাদের সাহায্য করব নূতন জীবনের আশার বাণী শেখাতে। ভালবাসার কথা স্বপ্নের কথা–
আমি গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান, মহাকাশবিদ্যা জিনেটিক এবং ব্যবহারিক জ্ঞানের কথা বলছিলাম—
গ্রুস্টানের মুখে হঠাৎ এক ধরনের চাপা হাসি খেলা করতে থাকে। হাসতে হাসতে সে তরল গলায় বলল, না লিয়ানা, না। মানবশিশুকে তোমরা অজ্ঞানতার অন্ধকারে ঠেলে দিও না। মানুষের শিক্ষা হবে শিল্পে, সাহিত্যে, সৌন্দর্যে। আশায় ভালবাসায়। নূতন স্বপ্লে। ব্যবহারিক জ্ঞান দিয়ে তাদের মনকে কলুষিত কোরো না। গণিতশাস্ত্র, বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি দিয়ে তাদের বিভ্রান্ত কোরো না। এই জ্ঞান খুব নিচুস্তরের জ্ঞান। এই জ্ঞান মানুষের উপযুক্ত জ্ঞান নয়। এই জ্ঞানচর্চা করবে রবোটেরা, তুচ্ছ রবোটেরা, তাদের হাস্যকর কপোট্রনে। মানুষের অপূর্ব মস্তিষ্ক এই জ্ঞানের অনেক উর্ধ্বে।
লিয়ানা ইতস্তত করে বলল, কিন্তু মহামান্য গ্রুস্টান–
এর মাঝে কোনো কিন্তু নেই লিয়ানা। মানুষের মস্তিষ্কে রয়েছে অচিন্তনীয় কল্পনাশক্তি। তাদের সেই অভূতপূর্ব শক্তিকে বিকশিত হতে আমাকে সাহায্য করতে দাও। প্রযুক্তি আর বিজ্ঞানের যুক্তিতর্কের সীমায় তাদের আবদ্ধ কোরো না। সেই অকিঞ্চিৎকর জ্ঞানটুকু আমি রবোটের কপোট্রনে সঞ্চারিত করে দেব। তোমাদের সেবায় রবোটেরা সেই জ্ঞানটুকু সমস্ত শক্তি দিয়ে নিয়োজিত করবে।
লিয়ানা একটা নিশ্বাস ফেলে বলল, মহামান্য গ্রুস্টান
বল লিয়ানা।
আমাদের আরো একটি কথা ছিল।
বল লিয়ানা। তোমাদের কথা শুনতেই আমি আজ এসেছি।
আমাদের এই বসতিতে শিশুর সংখ্যা খুব কম। আমাদের আরো শিত্র প্রয়োজন। আমাদের পুরুষ এবং মহিলারা একটি করে পরিবার সৃষ্টি করতে পারে, একটি–দুটি শিশু নিয়ে সেই পরিবারটি নূতন জীবন শুরু করতে পারে। ভ্রূণ ব্যাংক থেকে আমরা কি কিছু নূতন শিশু পেতে পারি?
গ্রুস্টান দীর্ঘ সময় চুপ করে থেকে বলল, লিয়ানা আমি তোমাদের বলেছি তোমরা যখন প্রস্তুত হবে আমি ভ্রূণ ব্যাংক থেকে তোমাদের শিশু এনে দেব। কিন্তু সে জন্যে তোমাদের প্রস্তুত হতে হবে–
আমরা প্রস্তুত মহামান্য গ্রুস্টান।
না– গ্রুস্টান তীব্র স্বরে বলল, তোমরা প্রস্তুত নও। তোমাদের মাঝে এখনো অসংখ্য ক্ষুদ্রতা, হীনমন্যতা, অসংখ্য কুটিলতা। তোমাদের মাঝে এখনো নানা ধরনের রূঢ়তা– এখনো ভালবাসার খুব অভাব। নূতন শিশু তোমাদের মাঝে এসে পরিপূর্ণভাবে বিকশিত হবে না লিয়ানা। আমি জানি।
লিয়ানা মাথা নিচু করে বসে রইল। গ্রুস্টান লিয়ানার কাছে এগিয়ে এসে বলল, লিয়ানা, আমি তোমাদের বুক আগলে বাঁচিয়ে রেখেছি, ক্ষুধায় খাবার দিয়েছি, প্রাকৃতিক দুর্যোগে আশ্রয় দিয়েছি, রোগশোকে ওষুধ দিয়েছি, চিকিৎসা দিয়েছি। আমি তোমাদের শিক্ষা দিয়েছি, যখন সময় হবে তোমাদের হাতে নূতন শিশু তুলে দেব। তাদের নিয়ে তোমরা আবার নূতন সভ্যতার সৃষ্টি করবে পৃথিবীতে। যে সভ্যতা ধ্বংস হয়েছে তার থেকে অনেক বড় হবে সেই সভ্যতা। অনেক মহান। সেটাই আমার স্বপ্ন। আমার আশা।
লিয়ানা নিচু গলায় বলল, আপনার স্বপ্ন সফল হোক মহামান্য গ্রুস্টান।
আমরা বিড়বিড় করে বললাম, সফল হোক। সফল হোক।
বিদায় আমার প্রিয় মানুষেরা।
বিদায়।
গ্রুস্টান ভেসে ভেসে উপরে উঠে গিয়ে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে বলে, আবার আমি আসব তোমাদের কাছে। আবার কথা বলব। কিন্তু জেনে রাখ, আমাকে যদি তোমরা নাও দেখ আমি কিন্তু তোমাদের সাথে আছি। সর্বক্ষণ আমি তোমাদের সাথে আছি। প্রতি মুহূর্তে। আমার ভালবাসার বন্ধনে তোমরা জড়িয়ে আছ আমার সাথে–তোমরা সবাই প্রতিটি মানুষ।
সমস্ত হলঘরটি হঠাৎ গাঢ় অন্ধকারে ঢেকে গেল। কয়েক মুহূর্ত এক ধরনের অসহনীয় নীরবতা, হঠাৎ এক ধরনের যান্ত্রিক শব্দ হতে থাকে মানুষের সম্মিলিত হাহাকারের মতো। সেই শব্দ ঘরের এক দেয়াল থেকে অন্য দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। আমরা নিশ্বাস বন্ধ করে বসে থাকি এক সময় শব্দ থেমে আসে, সমস্ত ঘরে আবার নীরবতা নেমে আসে। তখন হঠাৎ করে ঘরের ছাদে ঘোলাটে হলুদ আলো জ্বলে ওঠে। আমরা মাথা উঁচু করে একে অন্যের দিকে তাকাই, সবার চোখ এক ধরনের উত্তেজনায় জ্বলজ্বল করছে। কেউ কোনো কথা বলছে না, চুপ করে বসে আছে।