গ্রুস্টান ভয়ঙ্কর গর্জন করে আমার দিকে এগিয়ে আসে, চিৎকার করে বলে, মিথ্যাবাদী—
হ্যাঁ তুমি ঠিকই বলেছ, মিথ্যাবাদী। আমি যদি না হই তাহলে তুমি। কিন্তু তাতে কিছু আসে যায় না। অনেক মানুষ যখন একটা মিথ্যা কথা বিশ্বাস করে তখন সেই মিথ্যাটাই সত্যি হয়ে যায়। আমি নিশ্চিত এই বসতির মানুষ সেই মিথ্যা কথাটিই বিশ্বাস করবে। একটা কথা এখন বসতি থেকে বসতিতে ছড়িয়ে পড়বে–পৃথিবী মানুষ ধ্বংস করে নি, ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান–
কথা শেষ করার আগেই প্রচণ্ড আঘাতে আমি ছিটকে পড়ি। গ্রুষ্টান হঠাৎ আমার উপর হিংস্র পশুর মতো ঝাঁপিয়ে পড়ে, আমার হাত থেকে টিয়ারা ছুটে যায় একপাশে। গ্রুস্টান আমার কণ্ঠনালী চেপে ধরেছে ভয়ঙ্কর এক আক্রোশে—
আমি কোনোমতে বললাম, না গ্রুস্টান! আমি জানি তুমি আমাকে হত্যা করবে না। মৃত মানুষকে অত্যাচার করা যায় না। শুধু যন্ত্রণা দেবার জন্যে তুমি আমাকে শতাব্দীর পর শতাব্দী বাঁচিয়ে রাখবে। রাখবে না?
গ্রুস্টান আমাকে ছেড়ে দিয়ে বলল, হ্যাঁ কুশান, তুমি সত্যি কথা বলেছ। তুমি এই প্রথম একটি সত্যি কথা বলেছ।
আমি আমার গলায় হাত বুলাতে বুলাতে বললাম, তুমি জান তোমার মাঝে সবচেয়ে বিচিত্র অংশটুকু কী? তোমার সবচেয়ে বিচিত্র অংশ হচ্ছে মানুষের সাথে তোমার আশ্চর্য মিল। পৃথিবীর মানুষ যখন তোমাকে সৃষ্টি করে তারা কেন তোমাকে মানুষের রূপ দিয়েছিল মানুষের মতো একটি চরিত্র দিয়েছিল, আমি জানি না। কিন্তু মজার ব্যাপার কী জান?
গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে আমার দিকে হিংস্র দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। আমি তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে আবার বললাম, মজার ব্যাপার হচ্ছে মানুষের মহত্ত্ব তোমার মাঝে নেই। মানুষের ভালবাসাও নেই! মানুষের স্বপ্নও নেই। আছে মানুষের নীচতা। ক্ষুদ্রতা। মানুষের দুর্বলতা। মানুষের হিংস্রতা। আর জান সেটাই তোমাকে ধ্বংস করে দেবে চিরদিনের মতো।
আমাকে ধ্বংস করে দেবে?
হা গ্রুস্টান। মৃত্যুর জন্যে প্রস্তুত হও তুমি–যদি পরিব্যাপ্ত কম্পিউটার অপারেটিং সিস্টেমের ধ্বংসকে মৃত্যু বলা যায়।
তুমি কী বলতে চাইছ?
তুমি জান আমার একটি রবোট ছিল। অত্যন্ত প্রাচীন নির্বোধ রবোট। তার নাম ক্রিশি।
কী হয়েছে তার?
একটা বাই ভার্বালে করে আমি আর ক্রিশি এখানে এসেছি। তোমার রবোটেরা আমাকে ধরে এনেছে, ক্রিশিকে কিছু করে নি। কেন করবে? অত্যন্ত নির্বোধ প্রাচীন একটা রবোট তাকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই।
কী করেছে সেই রবোট?
আমি জানি না কী করেছে সে। কেমন করে জানব? তুমি আমাকে সিলাকিত করে রেখেছ। কিন্তু আমি অনুমান করতে পারি। যখন তোমার বিশাল নেটওয়ার্কটি দু ভাগে ভাগ করা হয়েছে সে এখানে ছিল। সে দেখেছে তোমাকে প্রচণ্ড আঘাত দেয়া হয়েছে, সে দেখেছে তুমি কিছুক্ষণের জন্যে সবকিছুর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছ। সে দেখেছে আমার জীবন হঠাৎ বিপন্ন হয়েছে।
গ্রুস্টানের চোখেমুখে হঠাৎ ভয়ঙ্কর এক ধরনের আক্রোশ এসে ভর করে। হিংস্র স্বরে হিসহিস করে বলল, তুমি কী বলতে চাইছ?
ক্রিশি আমার অনেক দিনের রবোট। সে আমার প্রাণ বাঁচানোর জন্যে যেটা করতে হয় করবে, তার স্বল্প বুদ্ধিতে, সেটা কি জান?
গ্রুস্টানের চেহারা হঠাৎ পাল্টে যেতে থাকে, সেখানে হঠাৎ এক আশ্চর্য আতঙ্ক এসে ভর করে। মাথা নেড়ে ফিসফিস করে বলে, না– না–কিছুতেই না–
হ্যা গ্রুস্টান। আমি নিশ্চিত সে বাই ভার্বালে করে ফিরে গেছে প্রশান্ত মহাসাগরের তীরে। যেখানে তোমার যোগসূত্রটি কেটে দু ভাগ করা হয়েছিল সেটা আবার জুড়ে দিচ্ছে তোমাকে রক্ষা করার জন্যে। কারণ সে মনে করে তুমি রক্ষা পেলে আমি রক্ষা পাব।
গ্রুস্টান কোনো কথা বলে না, হঠাৎ তার সমস্ত শরীর থরথর করে কাঁপতে থাকে। আমার দিকে অবিশ্বাসের দৃষ্টি নিয়ে তাকিয়ে আছে সে, আমি নিচু গলায় বললাম, তুমি জান তার অর্থ কী? তার অর্থ পৃথিবীর বিশাল নেটওয়ার্কে এখন দুজন গ্রুস্টান। একজন তুমি, আরেকজন পৃথিবীর অপর পৃষ্ঠে সৃষ্টি হওয়া দ্বিতীয় গ্রুস্টান। তোমার মতো নৃশংস। তোমার মতো হিংস্র। কিন্তু তুমি নও। সে ভিন্ন একজন।
গ্রুস্টান থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে বলল, না, না–তুমি মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা কথা বলছ–মিথ্যা–
আমি ভুল বলতে পারি, কিন্তু মিথ্যা বলছি না গ্রুস্টান! তুমি প্রায় ঈশ্বরের মতো শক্তিশালী, পৃথিবীর মানুষ কোনোদিন তোমাকে ধ্বংস করতে পারত না। তোমাকে ধ্বংস করতে পারবে শুধু তুমি। ঠিক তোমার মতো একজন নৃশংস হিংস্র খল কুটিল কুচক্রী অপারেটিং সিস্টেম। আমি তাই করেছি গ্রুষ্টান্ত– আরেকজন গ্রুস্টানের জন্ম দিয়ে তোমার সাথে দেখা করিয়ে দিচ্ছি।
হঠাৎ চারদিক থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি দেখতে পাই ধোঁয়ার মতো কিছু একটা গ্রুস্টানের পাশে ঘুরছে, কিছু একটা সৃষ্টি হচ্ছে। দ্বিতীয় গ্রুস্টান?
আমি হাঁটু গেড়ে গড়িয়ে গিয়ে টিয়ারাকে জড়িয়ে ধরে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, চোখ বন্ধ কর টিয়ারা।
কেন কুশান?
ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্যের সৃষ্টি হবে তোমার সামনে। ভয়ঙ্কর দৃশ্য! তুমি সহ্য করতে পারবে না–
আমার ভয় করছে কুশান। ভয় করছে—
আমারও ভয় করছে। এস আমি তোমাকে শক্ত করে ধরে রাখি। আমি টিয়ারাকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু সে আমার হাত থেকে কীভাবে জানি সরে যেতে থাকে। আমি প্রাণপণ চেষ্টা করতে করতে ফিসফিস করে বললাম, টিয়ারা, তুমি সত্যিকারের টিয়ারা নও। আমি সত্যিকারের কুশান নই! কিন্তু তবু আমি তোমাকে একটা কথা বলতে চাই।