আমি আবার সোজা হয়ে দাঁড়ালাম। বিশাল এক শূন্যতায় আমি স্থির হয়ে দাঁড়িয়েছি। আমি কান পেতে শোনার চেষ্টা করি, আবার কান্নার শব্দ ভেসে আসছে। মনে হয় খুব কাছে কেউ কাঁদছে। আমি কান্নার শব্দের দিকে নিজেকে টেনে টেনে নিয়ে যেতে থাকি।
আমি কতক্ষণ হেঁটেছি জানি না। শুরু নেই শেষ নেই এক আদিগন্ত বিস্তৃত শূন্যতায়। সময় যেন স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ স্পষ্ট হতে থাকে, বহুদূরে একটি ছায়ামূর্তিকে দেখা যাচ্ছে। দুই হাঁটুতে মুখ গুঁজে সে কাঁদছে। বাতাসে তার কালো চুল উড়ছে, সাদা কাপড় উড়ছে। দুঃখের কী আশ্চর্য একটি প্রতিমূর্তি।
আমি হেঁটে কাছে যেতেই ছায়ামূর্তিটি আমার দিকে মুখ তুলে তাকাল টিয়ারা।
টিয়ারা অবাক হয়ে আমার দিকে তাকিয়ে আছে। কয়েক মুহূর্ত সে কোনো কথা বলতে পারে না। হঠাৎ করে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, কুশান তুমি?
হ্যাঁ। আমি।
তোমাকেও গ্রুস্টান ধরে এনেছে?
না টিয়ারা, আমাকে গ্রুস্টান ধরে আনে নি।
তাহলে তুমি এখানে কেন এসেছ?
আমি তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছি।
নিয়ে যেতে এসেছ?
হা টিয়ারা।
তুমি আমাকে নিয়ে যাবে? কেমন করে নিয়ে যাবে? আমরা সিলাকিত হয়ে আছি।
আমি জানি।
তুমি সত্যিকারের কুশান নও। আমি সত্যিকারের টিয়ারা নই। এগুলো সব গ্রুস্টানের তৈরী প্রতিচ্ছবি। এখানে কিছু সত্যি নয়। সব মিথ্যা। সব কাল্পনিক।
হা টিয়ারা। শুধু কষ্টটা সত্যি।
কী কষ্ট কুশান কী ভয়ঙ্কর কষ্ট!
আমি তোমার কষ্ট দূর করে দেব। তুমি আমার কাছে এস। এস।
টিয়ারা হঠাৎ এক পা পিছিয়ে গিয়ে আর্তগলায় বলল, না।
কেন নয়?
ভয় করে। আমার ভয় করে। আমি যদি তোমাকে ছুঁয়ে দেখি তুমি নেই? তুমি যদি হারিয়ে যাও?
আমি হারিয়ে যাব না। আমি টিয়ারার দিকে হাত এগিয়ে দিয়ে বললাম, আমি যদি হারিয়ে যাই তাহলে আবার আমি তোমাকে খুঁজে বের করব। এস আমার কাছে এস।
না কুশান না। আমার ভয় করে। খুব ভয় করে।
তোমার ভয় নেই টিয়ারা, আমি তোমাকে রক্ষা করব।
না কুশান কেউ আমাকে রক্ষা করতে পারবে না, কেউ না।
মনে নেই আগে আমি তোমাকে রক্ষা করেছি? আবার আমি তোমাকে রক্ষা করব।
হঠাৎ খনখনে গলায় খুব কাছে থেকে কে যেন হেসে উঠল। আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম। কেউ নেই কোথাও, চারদিকে শুধু হালকা নীল আলো। আমি বললাম, কে?
খনখনে গলায় আবার হাসির শব্দ ভেসে আসে।
কে? কে হাসে?
টিয়ারা হঠাৎ ছুটে এসে আমাকে জাপটে ধরে ভয় পাওয়া গলায় বলল, গ্রুস্টান!
আমি টিয়ারাকে ধরে রেখে আবার চারদিকে তাকালাম, গ্রুস্টান তুমি কোথায়? তুমি কী চাও?
আমি কিছু চাই না।
গ্রুস্টান আমি তোমাকে দেখতে চাই।
কেন?
তোমার ক্ষমতা কেড়ে নেবার পর তুমি দেখতে কেমন হয়েছ আমি দেখতে চাই।
সাথে সাথে আমার সামনে গ্রুস্টানের প্রতিচ্ছবি ভেসে ওঠে। হালকা সবুজ রঙের সুদর্শন একটি মূর্তি। একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং কঠোর।
আমি কয়েক মুহূর্ত গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমাকে দেখে কিছু বোঝা যাচ্ছে না। তুমি দেখতে ঠিক আগের মতোই আছ।
হ্যাঁ। আমার ক্ষমতাও ঠিক আগের মতো আছে।
কিন্তু তোমার বিশাল নেটওয়ার্ক ছিল সেটি দু ভাগে ভাগ করে ফেলা হয়েছে। এখন তোমার ক্ষমতা আর আগের মতো নেই। অনেক কম। তুমি দুর্বল।
গ্রুস্টান আবার খনখন করে হেসে উঠে বলল, সূর্যকে দ্বিধাবিভক্ত করা হলে তার ঔজ্জ্বল্য কমে যায় না। পৃথিবীর জন্যে, পৃথিবীর মানুষের জন্যে আমার ক্ষমতা এতটুকু কমে নি। আমার যেটুকু শক্তি অবশিষ্ট আছে সেটি পৃথিবীর জন্যে যথেষ্ট। আমার প্রকৃত ক্ষমতার এক শতাংশ দিয়ে বিশ্বজগৎ ধ্বংস করে দেয়া যায়।
আমি জানি
তাহলে কেন তোমরা মিছিমিছি শক্তি ক্ষয় করছ? তোমরা জান না এখন আমি আমার রবোট বাহিনী পাঠিয়ে তোমাদের এক জন এক জন করে ধরে আনব?
জানি।
তোমরা কি জান না আমার নেটওয়ার্কে তোমরা আর স্পর্শ করতে পারবে না?
জানি। আমি খানিকক্ষণ গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে থেকে নরম গলায় বললাম, আমি তোমাকে একটা প্রশ্ন করি?
গ্রুস্টান কোনো কথা না বলে স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে রইল। আমি বললাম, তুমি কয়েক লক্ষ কম্পিউটারের একটি পরিব্যাপ্ত অপারেটিং সিস্টেম। নেটওয়ার্ক অর্ধেক করে দেয়ার পর তোমাকে নূতন করে নিজেকে দাঁড় করাতে হয়েছে। এই ভূখণ্ডের এই নেটওয়ার্কে তুমি যেরকম গ্রুস্টান, অন্য ভূখণ্ডের বাকি নেটওয়ার্কে ঠিক সেরকম আরেকজন গ্রুস্টান কি তৈরি হয় নি?
গ্রুস্টান কোনো কথা বলল না কিন্তু ভয়ঙ্কর এক দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি বললাম, তুমি বলতে চাইছ না কিন্তু আমি জানি। ঠিক তোমাকে আমি যেরকম দেখছি এ রকম আরো একজন গ্রুস্টানের জন্ম হয়েছে এখন। বাকি অর্ধেক নেটওয়ার্কে তার অস্তিত্ব। ঠিক তোমার মতো একজন গ্রুস্টান।
তুমি কী বলতে চাইছ কুশান?
সেই গ্রুস্টান ঠিক তোমার মতো শক্তিশালী। ঠিক তোমার মতো নৃশংস তোমার মতো হৃদয়হীন। তোমার মতো কুটিল কুচক্রী–
চুপ কর কুশান! চুপ কর—
যত সময় যাচ্ছে তোমরা দুই গ্রুস্টান তত ভিন্ন হয়ে যাচ্ছ। বিশেষ করে তুমি।
আমি কী?
গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে আমি খুব আশ্চর্য কিছু ছবি এনেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার ছবি কিন্তু সেগুলো তৈরি হয়েছে পৃথিবী ধ্বংসের আগে। আমি ছবিগুলো আমার বাই ভার্বালে রেখে এসেছিলাম এতক্ষণে সেগুলো এই বসতির সব মানুষের হাতে পৌঁছে গেছে। তুমি নিশ্চয়ই জান তার মানে কী? জান নিশ্চয়ই