আমি অন্ধকারে অস্তিত্বহীন হয়ে এক বিচিত্র শূন্যতায় ভেসে থাকি। সেই শূন্যতার কোনো শুরু নেই, কোনো শেষ নেই। কতকাল কেটে যায় আমি জানি না। দুঃখ কষ্ট যন্ত্রণার অনুভূতি নেই, শুধু এক বিশাল শূন্যতা। এক সময় সেই শূন্যতাও যেন অন্য এক শূন্যতায় মিলিয়ে যেতে থাকে। আমি নিজেকে ধরে রাখতে চাই কিন্তু ধরে রাখতে পারি না, এক অন্ধকার অতল গহ্বরে তলিয়ে যেতে থাকি।
খুব ধীরে ধীরে আবার আমার জ্ঞান ফিরে আসে। আমার চোখ খুলতে ভয় হয় আবার যদি সেই ভয়ঙ্কর অন্ধকার এসে আমাকে গ্রাস করে ফেলে? আমি হঠাৎ মৃদু একটা শব্দ শুনতে পেলাম, আমার নিশ্বাসের শব্দ। আমি তাহলে বেঁচে আছি? আমি চোখ খুলে তাকালাম, চারদিকে খুব হালকা বেগুনি রঙের একটা আলো। আমি নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। আমার হাত পা দেহ। আমার মুখ। আমার চোখ কান চুল।
আমি নিজেকে স্পর্শ করি, সাথে সাথে আমার সারা শরীর শিউরে ওঠে। এটি আমার শরীর নয়। আমি আবার ভালো করে তাকালাম এটি আমার সিলাকিত দেহ। আমার মস্তিষ্কের তথ্য ব্যবহার করে তৈরি করা এক কাল্পনিক অবয়ব। আমি চারদিকে ঘুরে তাকাই কোথাও কেউ নেই। গ্রুস্টানের কাল্পনিক জগতে আমি একা।
আমি উঠে দাঁড়ালাম, কী বিচিত্র অনুভূতি, মনে হয় মহাকাশে ভেসে আছি। আমি আছি কিন্তু তবু আমি নেই। আমি নিচু গলায় ডাকলাম, কে আছ এখানে?
আমার কথা প্রতিধ্বনিত হয়ে ফিরে এল, কিন্তু কেউ উত্তর দিল না। আমি আবার ডাকলাম, কে আছ?
খুব কাছে থেকে কে যেন বলল, কী চাও তুমি?
আমি চমকে উঠি, কে?
আমি। আমি গ্রুস্টান।
তুমি কোথায়?
আমি সর্বত্র। তোমার চারপাশে। তোমার ভিতরে।
আমি তোমাকে দেখতে চাই।
কেন?
কাউকে না দেখে আমি তার সাথে কথা বলে পারি না। আমি তোমার সাথে কথা বলতে চাই।
তুমি আমার সাথে কী কথা বলবে? আমি তোমার মস্তিষ্কের সব তথ্য বের করে নিয়ে আসতে পারি। তুমি কী ভাবছ আমি সব জেনে নিতে পারি।
কিন্তু আমি নিজে থেকে তোমাকে বলতে চাই।
কী বলতে চাও?
খুব জরুরি একটা কথা বলতে চাই। আমি তাই নিজে থেকে তোমার কাছে এসেছি।
বল।
তার আগে আমি তোমাকে দেখতে চাই। তুমি আমার সামনে দেখা দাও।
খুব ধীরে ধীরে গ্রুস্টানের চেহারা সৃষ্টি হতে থাকে। হালকা সবুজ রঙের দেহ একই সাথে মানব এবং মানবী। একই সাথে কোমল এবং নিষ্ঠুর। গ্রুস্টান আমার দিকে তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল, তুমি কী বলতে চাও?
এখন দিন না রাত?
রাত। কেন?
তুমি কখন আমাকে সিলাকিত করেছ? দশ ঘণ্টা কি হয়ে গেছে?
এখনো হয় নি। কেন?
তুমি আমার মস্তিষ্কের তথ্যে উঁকি দিলে জানতে। দশ ঘণ্টার মাঝে তোমার ক্ষমতাকে আমরা অর্ধেক করে দেব।
গ্রুস্টান কয়েক মুহূর্ত স্থির হয়ে থাকে। নিশ্চয়ই সে আমার কথার সত্যতা যাচাই করে দেখছে। দেখতে দেখতে তার চেহারা ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে, তার সমস্ত দেহ লাল হয়ে কুৎসিত একটি রূপ নিয়ে নেয়। সে আমার কাছে এগিয়ে এসে আমাকে আঘাত করে, প্রচও যন্ত্রণায়। আমি ছিটকে পড়ি। এটি শারীরিক যন্ত্রণা নয়, যন্ত্রণার অনুভূতি। শরীরকে পাশ কাটিয়ে মস্তিষ্কে দেয়া যন্ত্রণার এক তীব্র অনুভূতি। গ্রুস্টান আমার কাছে ঝুঁকে পড়ে হিসহিস করে বলল, নির্বোধ মানুষ! আমার ক্ষমতা অর্ধেক করে দেয়া হলে কী হবে জান? তোমার অস্তিত্ব ধ্বংস হবে সবার আগে। তুমি বেঁচে আছ কারণ আমি বেঁচে আছি। আমার অস্তিত্বে আঘাত করে তুমি বেঁচে থাকবে না। গ্রুস্টান আমার দিকে এগিয়ে আসে আর ঠিক তখন খুব বিচিত্র একটা ব্যাপার ঘটল। গ্রুস্টানের সমস্ত দেহ যেন ছিন্নভিন্ন হয়ে যেতে থাকে। ভয়ঙ্কর চিৎকার করে সে তার নিজেকে ধরে রাখতে চেষ্টা করে কিন্তু কিছুই যেন আর স্থির হয়ে থাকতে চায় না।
আমি হঠাৎ করে বুকের ভিতরে এক প্রচণ্ড চাপ অনুভব করি। আমার দৃষ্টি ঘোলাটে হয়ে আসে, আমার সিলাকিত দেহ থরথর করে কেঁপে ওঠে। আমি গ্রুস্টানের দিকে তাকিয়ে ফিসফিস করে বললাম, তোমার নেটওয়ার্ক দু ভাগে ভাগ করে ফেলেছে গ্রুস্টান। তুমি আর কোনোদিন তোমার আগের ক্ষমতা ফিরে পাবে না–
আমি কথা শেষ করার আগেই হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণায় এক অন্ধকার জগতে তলিয়ে গেলাম। আমার সিলাকিত দেহ কি গ্রুস্টান বাঁচাতে পারবে? আমি জানি না। আমি নিজের ভিতরে এক ধরনের শূন্যতা অনুভব করি। কিছুতেই আর কিছু এসে যায় না।
এটাই কি মৃত্যু?
.
তারপর কতকাল কেটে গেছে জানি না। হয়তো কয়েক মুহূর্ত, হয়তো কয়েক যুগ। আমি চোখ মেলে তাকালাম, চারদিকে একটা নীল জলো। খুব ভোরবেলা যেরকম আলো হয় অনেকটা সেরকম। আমি কান পেতে থাকি কাঁথাও কেউ একজন কাঁদছে। ব্যাকুল হয়ে কান্না নয়, কেমন জানি ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কৃামাই শুনে বুকের মাঝে কেমন জানি এক ধরনের কষ্ট হয়।
আমি মাথা ঘুরিয়ে তাকালাম, চারদিকে বিশাল নিঃসীম শূন্যতা। যতদূর চোখ যায়। কোথাও কিছু নেই। আমি আমার নিজের দিকে তাকালাম, এই তো আমার শরীর। হাত পা মুখ। আমি আবার নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি। কী বিচিত্র এক অনুভূতি, আমার নিজের শরীর তবু মনে হয় নিজের নয়।
আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। কী বিষণ্ণ করুণ কান্নার স্বর! কোথা থেকে আসে?
আমি উঠে দাঁড়ালাম। মনে হলে আমি বুঝি ভেসে যাব। আমার সামনে কিছু নেই পিছনে কিছু নেই। আমার নিচে কিছু নেই উপরে কিছু নেই। চারদিকে শুধু খুব হালকা। একটা নীল আলো। আমি আবার কান্নার শব্দটা শুনতে পেলাম। সামনে থেকে আসছে। আমি সেদিকে হাঁটতে চেষ্টা করে হঠাৎ হুমড়ি খেয়ে পড়ে গেলাম, আমার পায়ে কোনো জোর নেই। আমি অতলে পড়ে যেতে থাকি, হাত দিয়ে কিছু একটা ধরার চেষ্টা করলাম কিন্তু কোথাও কিছু নেই। আমি নিজেকে ধরে রাখতে পারি না, পড়ে যেতে থাকি। কতক্ষণ কেটে যায় এভাবে আমি জানি না। আমি কি সত্যিই পড়ে যাচ্ছি নাকি সবই আমার কল্পনা?