আমি যখন বাই ভার্বালে দাঁড়িয়ে ক্রিশিকে সেটা চালু করার আদেশ দিয়েছি তখন হঠাৎ দেখতে পেলাম দূর থেকে দ্রুন হাতে কয়েকটা ছবি নিয়ে ছুটে আসছে। আমি ক্রিশিকে থামতে বললাম, কয়েক সেকেন্ডের মাঝেই দ্রুন আমার কাছে এসে দাঁড়াল। আমি তার দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী হয়েছে দ্রুন?
তুমি এই ছবিগুলো দেখ।
কিসের ছবি?
কম্পিউটারের মেমোরি থেকে বের করেছি। পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবার আগে বড় বড় নগরের ছবি।
এই ধরনের ছবি দেখলে বুকে এক ধরনের কষ্ট হয় কিন্তু সেগুলো এভাবে ছুটে এসে আমাকে কেন দেখানো হচ্ছে আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না। আমি দ্রুনের দিকে তাকাতেই দ্রুন আমার হাতে আরো অনেকগুলো ছবি ধরিয়ে দিল, একই নগরের ছবি কিন্তু পারমাণবিক বিস্ফোরণে ধ্বংস হয়ে যাবার পর। এই ছবিগুলো দেখলে বুকের ভিতরে এক বিচিত্র ধরনের ক্রোধের জন্ম হয়। আমি খানিকক্ষণ নিশ্বাস বন্ধ করে থেকে বললাম, দ্রুন এই ছবিগুলো তুমি আমাকে কেন দেখাচ্ছ?
তুমি ছবিগুলো কবে তোলা হয়েছে সেই তারিখটি দেখ।
আমি তারিখ দেখে চমকে উঠি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার দুই বছর আগের ছবি! দ্রুনের দিকে ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, এটি কেমন করে হয়?
আমি জানি না কেমন করে হয়, কিন্তু হয়েছে। এগুলো কাল্পনিক ছবি, পৃথিবী ধ্বংস হওয়ার পর কেমন দেখাবে তার ছবি।
তার মানে?
তার মানে পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাওয়ার অনেক আগেই গ্রুস্টান জানত পৃথিবী ধ্বংস হয়ে যাবে।
কিন্তু কেমন করে জানল সে? কেমন করে জানল ভবিষ্যতে কী হবে?
ইশি এগিয়ে এসে নিচু গলায় বলল, ভবিষ্যতে কী হবে সেটি জানার একটি মাত্র উপায়।
কী?
সেই ভবিষ্যতটি যদি নিজের হাতে তৈরি করা হয়।
আমি চমকে ইশির দিকে তাকালাম, তুমি কী বলতে চাইছ ইশি?
আমি নিঃসন্দেহ কুশান। মানুষ এই পৃথিবী ধ্বংস করে নি, এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান।
১০. বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ
বাই ভার্বালটি তীক্ষ্ণ শব্দ করে বসতিটির উপর দিয়ে একবার ঘুরে যায়। আমি দেখতে পাই বেশ কিছু মানুষ খোলা জায়গাটিতে জড়ো হয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে আমাকে লক্ষ করছে। আমি বাই ভার্বালটিকে সাবধানে নিচে নামিয়ে আনতেই অনেক মানুষ আমাকে ঘিরে দাঁড়াল। তাদের চোখে এক ধরনের অবিশ্বাস্য বিস্ময়। আমি এবং আমার পিছু পিছু ক্রিশি বাই ভার্বাল থেকে নিচে নেমে এলাম লোকগুলো সাথে সাথে এক পা পিছিয়ে যায় তাদের চোখে হঠাৎ এক ধরনের আতঙ্ক এসে ভর করেছে।
আমি গলার স্বর যতটুকু সম্ভব স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে বললাম, আমার নাম কুশান।
আমাকে ঘিরে থাকা মানুষগুলো কোনো কথা বলল না। চোখ বড় বড় করে আমার দিকে তাকিয়ে রইল।
আমি আবার সহজ গলায় বললাম, আমি এসেছি টিয়ারাকে উদ্ধার করতে।
মানুষগুলো চমকে উঠে আমার দিকে তাকায়। আমি হাসার চেষ্টা করে বললাম, পারব কি না জানি না। কিন্তু চেষ্টা তো করে দেখতে হবে। কী বল?
কেউ কোনো কথা বলল না, শুধু কমবয়সী একজন ছেলে উৎসাহে চোখ উজ্জ্বল করে মাথা নাড়তে থাকে। ঘিরে থাকা মানুষগুলোর মাঝে থেকে অসুখী চেহারার একজন মানুষ। হঠাৎ এগিয়ে এসে বলল, তুমি কেমন করে টিয়ারাকে উদ্ধার করবে? তাকে সিলাকিত করে রাখা হয়েছে।
আমি জানি।
তা হলে? তুমি কেমন করে উদ্ধার করবে?
আমি এখনো জানি না।
লোকটি ভুরু কুঁচকে আমার দিকে তাকিয়ে বলল, তুমি সমস্ত সর্বনাশের মূল। টিয়ারা আমাকে সঙ্গী হিসেবে বেছে নেবে বলেছিল। আমরা ভ্রূণ ব্যাংক থেকে একটা শিশু নিতে পারতাম। তোমার জন্যে সবকিছু গোলমাল হয়ে গেছে। তোমার জন্যে।
আমার জন্যে?
হ্যাঁ।
লোকটি, যার নাম নিশ্চয়ই ক্লিচি–গলা উঁচু করে বলল, তোমাকে আমি ঘৃণা করি। ঘৃণা।
তুমি যদি সত্যি কাউকে ঘৃণা করতে চাও তাহলে সেটা হওয়া উচিত গ্রুস্টান। এই পৃথিবী ধ্বংস করেছে গ্রুস্টান তুমি সেটা জান?
আমার কথা শেষ হবার আগেই আমি দেখতে পেলাম দুজন প্রতিরক্ষা রবোট আমার দিকে ছুটে আসছে। আমাকে ঘিরে থাকা মানুষেরা সরে গিয়ে তাদের জায়গা করে দিল।
একটি রবোট আমার খুব কাছে দাঁড়িয়ে বলল, মহামান্য কুশান, আমরা আপনাকে নিতে এসেছি।
কোথায়?
মহামান্য গ্রুস্টানের কাছে।
আমাকে একটু সময় দাও, আমি কথা বলছি।
আমরা খুব দুঃখিত। আপনাকে এই মুহূর্তে নিয়ে যাওয়ার কথা।
আমি পিছনে ফিরে তাকালাম এবং কিছু বোঝার আগেই ঘাড়ের কাছে একটা তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করি। জ্ঞান হারানোর আগে দেখতে পাই ক্রিশি স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে আছে।
.
আমি যখন চোখ খুলে তাকালাম তখন চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। এই অন্ধকার এত ভয়ঙ্কর যে আমি বেশিক্ষণ চোখ খুলে তাকিয়ে থাকতে পারি না। এক সময় চোখ বন্ধ করে ফেলি। চারদিকে এক আশ্চর্য নৈঃশব্দ্য। এই ধরনের নৈঃশব্দ্য আমি আগে কখনো অনুভব করি নি, আমি আমার নিশ্বাসের শব্দও শুনতে পাই না। আমি কান পেতে থেকেও আমার হৃৎস্পন্দনের শব্দ শুনতে পাই না। আমি কি বেঁচে আছি?
আমি আবার চোখ খুলে তাকালাম, কী ভয়ঙ্কর অন্ধকার। আমার নিশ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায়। একটু আলোর জন্যে আমার সমস্ত চেতনা যেন বুভুক্ষু হয়ে থাকে, কিন্তু কোথাও কোনো আলো নেই। শুধু অন্ধকার, কঠিন নিষ্করুণ অন্ধকার। আমি হাত দিয়ে নিজেকে স্পর্শ করার চেষ্টা করি কিন্তু নিজেকে খুঁজে পাই না। কোথায় আমার দেহ? আমার হাত পা মুখ? কোথায় আমার চোখ? আমার নাক কান বুক? আমি কোথায়? ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নের মতো এক ধরনের আতঙ্কে আমার চেতনা শিউরে শিউরে ওঠে, আমি চিৎকার করে উঠতে চাই কিন্তু কোথাও এতটুকু শব্দ হয় না। এই তাহলে সিলাকিত? আমি আছি কিন্তু আমি নেই? অস্তিত্বহীন একজন মানুষ? শুধু তার অনুভূতি? তার যন্ত্রণা? কতকাল আমাকে এভাবে থাকতে হবে? কতকাল?