রাইনুক একটু অধৈর্য হয়ে বলল, কিন্তু এইভাবে নিজেদের একটা লক্ষ্যবস্তু হিসেবে তৈরি করে বসে থাকব কেন? কী আছে এখানে?
ক্লড তার কপালের ব্যান্ডেজে হাত বুলিয়ে আস্তে আস্তে বলল, আমার মনে হয় এই কম্পিউটারের মেমোরিতে কিছু অমূল্য তথ্য আছে। গ্রুস্টান সেজন্যেই এভাবে এটাকে আগলে রাখছে।
কিন্তু আমরা সেই তথ্য বের করতে পারছি না, দুই সপ্তাহ হয়ে গেল–
আমি ক্লডের দিকে তাকিয়ে বললাম, ক্লড।
বল কুশান
তুমি এতদিন খুব সাবধানে এই গেটওয়ে কম্পিউটারের মেমোরি থেকে কিছু তথ্য বের করতে চাইছিলে যেন গ্রুস্টান জানতে না পারে। এখন গ্রুস্টান জেনে গেছে। আমরা যে এখানে আছি সেটা আর গোপন নেই। তুমি কি এখন সোজাসুজি কোয়ার্টজ ফাইবার কেটে বা অন্য কোনোভাবে খুব তাড়াতাড়ি কিছু তথ্য বের করতে পারবে?
ক্লড মাথা নেড়ে বলল, গত দুই সপ্তাহে যেটা পারি নি দুই ঘণ্টায় সেটা বের করতে পারব।
তুমি কতটুকু নিশ্চিত?
একজন মানুষের পক্ষে যেটুকু নিশ্চিত হওয়া সম্ভব।
চমৎকার। তুমি তাহলে কাজ শুরু করে দাও। তথ্যটুকু বের করার সাথে সাথে তোমরা সবাই এখান থেকে চলে যাবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব।
সবাই আমার দিকে তাকাল। ইশি মৃদু স্বরে বলল, কুশান তুমি “আমরা সবাই” না বলে “তোমরা সবাই” কেন বলছ? তুমি কী করবে?
আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, আমি জানি না, ইশি
এখন কি আমাদের সবার একসাথে থাকা উচিত না?
আমি জানি না। আমি খানিকক্ষণ ইশির দিকে তাকিয়ে থেকে বললাম, তোমরা যদি কিছু মনে না কর, আমি খানিকক্ষণ একা থাকতে চাই।
ইশি বলল, ঠিক আছে কুশান।
আমি কম্পিউটার ঘর থেকে বের হয়ে এলাম। বাইরে তখন অন্ধকার কেটে ভোরের আলো ফুটে উঠতে শুরু করছে। ভোরের এই আলোতে পৃথিবীর সবকিছু অপূর্ব মনে হয় কিন্তু আজ কিছুই আমার চোখে পড়ছে না।
.
সূর্য যখন ঠিক মাথার উপরে উঠেছে, চারদিক ভয়ঙ্কর গরমে ধিকিধিকি করে জ্বলছে, ঠিক সেরকম সময়ে হঠাৎ নাইনা ছুটতে ছুটতে আমার কাছে এল। অনেক দূর দৌড়ে এসেছে তাই তখনো হাঁপাচ্ছে, কিছু একটা বলতে চাইছে কিন্তু এত উত্তেজিত হয়ে আছে যে। কথা বলতে পারছে না। আমি অবাক হয়ে বললাম, কী হয়েছে নাইনা?
নাইনা বড় একটা নিশ্বাস নিয়ে কোনোমতে বলল, টিয়ারা টিয়ারা–
কী হয়েছে টিয়ারার?
দেখা যাচ্ছে টিয়ারাকে। হলোগ্রাফিক স্ক্রিনে—
দেখা যাচ্ছে? টিয়ারাকে?
হ্যাঁ। নাইনা মাথা নেড়ে বলল, গ্রুস্টানের সাথে।
আমি আর কোনো কথা না বলে এক লাফে উঠে দাঁড়িয়ে ছুটতে থাকি। নাইনা আমার পিছু পিছু আসতে থাকে।
আমাকে দেখে সবাই সরে দাঁড়াল, আমি পাশ কাটিয়ে ভিতরে ঢুকে গেলাম। দেয়ালে বড় হলোগ্রাফিক স্ক্রিন, সেখানে টিয়ারার প্রতিচ্ছবি। এত জীবন্ত যে দেখে মনে হচ্ছে আমি ইচ্ছে করলে তাকে স্পর্শ করতে পারব। টিয়ারা মাথা ঘুরিয়ে চারদিকে তাকাল, তার দুই চোখে এক ধরনের আতঙ্ক। হঠাৎ সে কী একটা দেখে চমকে উঠে দুই হাতে মুখ ঢেকে ফেলল, ভয় পেয়েছে সে। কী দেখে ভয় পেয়েছে?
আমি নিশ্বাস বন্ধ করে তাকিয়ে থাকি, স্ক্রিনে হঠাৎ গ্রুস্টানের চেহারা ভেসে আসে। ভয়ঙ্কর ক্রোধে তার মুখ বিকৃত হয়ে আছে। তার সমস্ত মুখ মনে হয় খুলে খুলে আলাদা হয়ে যাচ্ছে, সেগুলো নড়তে থাকে, কাঁপতে থাকে, তার চাপা গলার স্বর হঠাৎ হিসহিস করে ওঠে, তুমি ভেবেছ আমার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করবে? অর্বাচীন নির্বোধ মেয়ে।
টিয়ারা আতঙ্কে ফ্যাকাশে হয়ে যায়, সে মাথা নাড়তে থাকে, তারপর হঠাৎ হাঁটু ভেঙে পড়ে যায়।
গ্রুস্টান হঠাৎ দুই পা এগিয়ে এসে চাপা গলায় বলল, তোমাকে আমি যেভাবে ধরে এনেছি ঠিক সেভাবে আমি এক জন এক জন করে তোমাদের সবাইকে ধরে আনব। সবাইকে। আমি জানি তারা কোথায়। মানুষের সভ্যতার বিরুদ্ধে তোমাদের বিশ্বাসঘাতকতার শাস্তি দেব আমি নিষ্ঠুর হাতে। তোমার সিলাকিত শরীর আমি বাচিয়ে রাখব লক্ষ লক্ষ বছর। তোমার মস্তিষ্কে দেয়া হবে অচিন্তনীয় যন্ত্রণা। ভয়ঙ্কর অভিশাপের মতো তুমি ধুকে ধুকে বেঁচে থাকবে, তার থেকে কোনো মুক্তি নেই। নির্বোধ মেয়ে তোমার কোনো মুক্তি নেই।
গ্রুস্টান হঠাৎ এগিয়ে এসে হাত ঘুরিয়ে আঘাত করে টিয়ারাকে। সে ছিটকে পড়ে মাটিতে, অনেক কষ্টে মুখ তুলে তাকায়, হঠাৎ মনে হয় সে বড় বড় চোখে আমার দিকে তাকিয়ে আছে, কী কাতর সেই দৃষ্টি! আমি আর সহ্য করতে পারলাম না, একটা আর্তচিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেললাম।
দ্রুন আমার হাত স্পর্শ করে বলল, কুশান এটি সত্যি নয়। এগুলো সব কৃত্রিম প্রতিচ্ছবি।
কিন্তু টিয়ারার কষ্টটা তো সত্যি। সত্যি না?
দ্রুন কোনো কথা না বলে চুপ করে দাঁড়িয়ে রইল। আমি ফিসফিস করে বললাম, আমি আর সহ্য করতে পারছি না। কেউ একজন এই স্ক্রিনটা বন্ধ করে দেবে?
ক্লড হাত বাড়িয়ে কী একটা স্পর্শ করতেই পুরো হলোগ্রাফিক স্ক্রিনটা অন্ধকার হয়ে গেল। আমি কয়েক পা পিছনে সরে এসে দেয়ালে হেলান দিয়ে মেঝেতে পা ছড়িয়ে বসে পড়লাম। আমি চোখ বন্ধ করে বসে থাকি এবং হঠাৎ করে বুঝতে পারি আমার কী করতে হবে। আমি সাথে সাথে চোখ খুলে তাকালাম। আমাকে ঘিরে বিষণ্ণ মুখে পাথরের মতো সবাই দাঁড়িয়ে আছে। আমি একবার সবার ওপর দিয়ে চোখ বুলিয়ে আনি, তারপর কষ্ট করে মুখে একটা হাসি ফুটিয়ে এনে বললাম, আমাকে গ্রুস্টানের কাছে যেতে হবে।